ভারতের জলবায়ু: নিয়ন্ত্রকসমূহ, বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ

​ভারতের জলবায়ু হল মূলত ক্রান্তীয় মৌসুমী প্রকৃতির। তবে বিশাল ভৌগোলিক আয়তন, বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতি এবং সমুদ্রের নৈকট্যের কারণে স্থানভেদে এবং ঋতুভেদে ভারতের জলবায়ুর চরিত্রে চরম বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই বৈচিত্র্যই ভারতকে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় জলবায়ু অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।


ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রকসমূহ:

ভারতের জলবায়ু মূলত ক্রান্তীয় মৌসুমী প্রকৃতির হলেও এর বিশাল ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং অবস্থানগত কারণে একাধিক উপাদান এই জলবায়ুকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এদের মধ্যে প্রধান নিয়ন্ত্রকগুলি নিম্নরূপ:

1. অক্ষাংশগত অবস্থান:

 ভারত 8°4'N থেকে 37°6'N অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। 23.5°N অক্ষাংশে অবস্থিত কর্কটক্রান্তি রেখাটি দেশের প্রায় মাঝখান দিয়ে গিয়েছে। এর ফলে ভারতের দক্ষিণাংশ ক্রান্তীয় মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সারা বছর উষ্ণ তাপমাত্রা থাকে। অন্যদিকে, উত্তরাংশ উপ-ক্রান্তীয় মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেখানে তীব্র গ্রীষ্ম ও শীত অনুভূত হয়। এই কারণে ভারতের জলবায়ুর প্রকৃতি মূলত ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ুর সংমিশ্রণ।

2. হিমালয় পর্বতমালা:

হিমালয় পর্বতমালাকে ভারতের জলবায়ুর সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ন্ত্রক বলা হয়। এর প্রভাব ভারতের জলবায়ুতে মূলত দু'ভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, হিমালয়ের কারণে শীতকালে উত্তর দিক থেকে আসা সাইবেরিয়ার তীব্র শীতল বায়ু ভারতে প্রবেশ করতে পারে না। এর ফলে উত্তর ভারত ইউরোপের মতো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ থেকে রক্ষা পায় এবং জলবায়ু অপেক্ষাকৃত উষ্ণ থাকে। দ্বিতীয়ত, হিমালয় পর্বতমালা গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুকে বাধা দেওয়ায় তা সারা ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়। যদি হিমালয় না থাকত, তবে এই বায়ু ভারতে বৃষ্টিপাত না ঘটিয়ে উত্তর দিকে চলে যেত এবং ভারত শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হতো।

3. সমুদ্র থেকে দূরত্ব:

 সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলগুলিতে জলবায়ু সমভাবাপন্ন বা মৃদু প্রকৃতির হয় (যেমন: মুম্বাই, চেন্নাই)। এখানে গ্রীষ্মে অত্যধিক গরম বা শীতে অত্যধিক ঠান্ডা অনুভূত হয় না। কারণ জলভাগের তাপ গ্রহণ ও বর্জন করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। সমুদ্র থেকে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হয় (যেমন: দিল্লি, কানপুর)। এই অঞ্চলগুলিতে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা খুব বেশি হয় এবং শীতকালে তাপমাত্রা খুব কমে যায়। একে মহাদেশীয় জলবায়ুর প্রভাব বলা হয়।

4. সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা:

 সাধারণভাবে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি 1000 মিটার উচ্চতায় তাপমাত্রা প্রায় 6.4°C হারে কমতে থাকে। এই কারণে সমভূমি অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চল বা উচ্চভূমিতে জলবায়ু অধিক শীতল হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মকালে সমতলে যখন তীব্র গরম, তখন দার্জিলিং বা সিমলার তাপমাত্রা মনোরম থাকে।

5. ভূ-প্রকৃতি:

বিভিন্ন পাহাড়, পর্বত, মালভূমি এবং সমভূমির অবস্থান জলবায়ুকে স্থানীয়ভাবে প্রভাবিত করে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা হলো এর অন্যতম প্রধান উদাহরণ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু যখন পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে বাধা পেয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়, তখন পর্বতের পূর্ব ঢাল  বৃষ্টিপাতের অভাবে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পরিণত  হয় (যেমন: মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ ও কর্ণাটকের কিছু অংশ)। এছাড়া, ভূ-প্রকৃতি বায়ুপ্রবাহের গতিপথ ও আর্দ্রতাকে প্রভাবিত করে স্থানীয় বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

6. মৌসুমী বায়ুচক্র:

ভারতের জলবায়ুর অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক হলো মৌসুমী বায়ু। গ্রীষ্মকালে স্থলভাগে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ায় সমুদ্র থেকে আর্দ্র বায়ু (দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু) স্থলভাগে প্রবেশ করে এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই বৃষ্টিপাতের ফলে স্থানীয় তাপমাত্রা গড়ে প্রায় 8°-10°C কমে যায়।  শীতকালে আবার স্থলভাগে উচ্চচাপ থাকায় বায়ু স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। তাই ভারতে শীতকাল শুষ্ক প্রকৃতির হয়।

7. জেট স্ট্রিম:

পশ্চিম দিক থেকে আসা দ্রুতগামী উচ্চাকাশের বায়ুপ্রবাহ উত্তর ভারতে শীতকালীন আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পশ্চিমা ঝঞ্ঝাগুলিকে ভারতে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। এই বায়ু প্রবাহ 'সাবট্রপিক্যাল ওয়েস্টার্লি জেট স্ট্রিম' নামে পরিচিত।


ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমী বায়ুর ভূমিকা:

ভারতের জলবায়ু সম্পূর্ণরূপে মৌসুমী বায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই ভারতীয় জলবায়ুকে প্রায়শই ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু বলা হয়। মৌসুমী কথাটি আরবি শব্দ 'মৌসুম' থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ঋতু। এই বায়ুপ্রবাহ নির্দিষ্ট ঋতুতে তার দিক পরিবর্তন করে বলে একে মৌসুমী বায়ু বলা হয়। মৌসুমী বায়ু কেবল বৃষ্টিপাত ঘটায় এমনটাই নয়, এটি ভারতের কৃষি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ভারতের মৌসুমী বায়ু প্রবাহকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

1. দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (গ্রীষ্মকালীন):

মৌসুমী বায়ুর এই শাখাটি হলো ভারতের প্রধান বৃষ্টিপাত সৃষ্টিকারী বায়ু। এটি জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। স্থলভাগের নিম্নচাপের টানে সমুদ্র থেকে আর্দ্র বায়ু স্থলভাগে প্রবেশ করে এবং এই সময়ে ভারতের প্রায় ৮০%-এরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়।

2. উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু (শীতকালীন):

উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর শাখাটি মূলত স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। এটি শুষ্ক হলেও বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় আর্দ্রতা সংগ্রহ করে তামিলনাড়ুর উপকূলে শীতকালে বৃষ্টিপাত ঘটায়।


ভারতের ঋতুচক্র:

ঋতুচক্র মূলত মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের আগমন ও প্রত্যাগমন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ​ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ ভারতের ঋতুচক্রকে সাধারণত চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছে। নিচে প্রতিটি ঋতুর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আলোচনা করা হলো:

1. শীতকাল: 

সময়কাল: নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত।

বৈশিষ্ট্য:

  • এই সময় ভারতে নিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে, বিশেষত উত্তর ভারত এবং হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে। আকাশ সাধারণত পরিষ্কার থাকে এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকে।
  • ​উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বায়ুপ্রবাহ হয়, যা শুষ্ক ও শীতল।
  • উত্তর ভারতে শৈত্যপ্রবাহ: জানুয়ারি মাস হল উত্তর ভারতের শীতলতম মাস। এইসময় এখানকার সমভূমি অঞ্চলে তাপমাত্রা 10°C-এর নীচে নেমে যায়। হিমালয়ের উঁচু উঁচু স্থানগুলিতে আবার তুষারপাতও হয়।
  • দক্ষিণ ভারতে উষ্ণতা: দক্ষিণ ভারত (উপকূলীয় অঞ্চল) সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় সেখানকার তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে (20°C থেকে 25°C এর কাছাকাছি)।
  • পশ্চিমা ঝঞ্ঝার প্রভাব: ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা পশ্চিমা ঝঞ্ঝা-র প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাত বা তুষারপাত হয়। যা রবি শস্য (যেমন গম) চাষের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

​2. গ্রীষ্মকাল:

সময়কাল: মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত।

বৈশিষ্ট্য: এই সময় সূর্য বিষুবরেখা থেকে কর্কটক্রান্তি রেখার দিকে সরতে থাকে। ফলে সারা ভারত জুড়েই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং বায়ুচাপ কমতে থাকে।

  • উচ্চ তাপমাত্রা: এপ্রিল থেকে মে মাসে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সমভূমি অঞ্চলে তাপমাত্রা 40°C-এরও বেশি হতে পারে। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশেও তাপমাত্রা প্রায় 40°C-তে পৌঁছে যায়।
  • লু: উত্তর-পশ্চিম ভারতের সমভূমি অঞ্চলে দুপুরের দিকে অত্যন্ত উষ্ণ, শুষ্ক এবং ধূলিপূর্ণ বায়ুপ্রবাহ লক্ষ্য করা যায়, যা স্থানীয় ভাষায় 'লু' নামে পরিচিত। এর প্রভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা অসুস্থ হয়ে পরে।
  • কালবৈশাখী: গ্রীষ্মকালে দুপুরের পর মাঝে মাঝে পূর্ব ভারতে (বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে) বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়, বৃষ্টি ও শিলা বৃষ্টি হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে এটিকে স্থানীয় ভাষায় কালবৈশাখী বলে। অসমে এই ঝড় 'বরদৌছিলা' নামে পরিচিত। এটি চা ও ধান চাষের জন্য উপকারী।
  • আঁধি: গ্রীষ্মকালে রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলে মাঝে মাঝে জোরালো ধূলিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে। একে স্থানীয় ভাষায় আঁধি বলে। এই ঝড়ের প্রভাবে প্রচণ্ড ধুলো উড়লেও বৃষ্টিপাত হয় না।
  • আম্রবৃষ্টি: গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে কর্ণাটক ও কেরলের উপকূলবর্তী অঞ্চলে যে বৃষ্টিপাত হয় তাকে আম্রবৃষ্টি বলে। এই বৃষ্টিপাত দ্রুত আম পাকতে সাহায্য করে।
  • ব্লসম শাওয়ার: গ্রীষ্মকালে কেরালা ও তার পার্শ্ববর্তী উপকূল অঞ্চলে সমুদ্র থেকে আগত আদ্র বায়ুর প্রভাবে জোরালো বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই বৃষ্টিপাত কেরালায় কফি ফুল ফোটাতে সাহায্য করে।

3. বর্ষাকাল:

সময়কাল: জুন মাসের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত।

বৈশিষ্ট্য: এই ঋতুতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আগমনের ফলে ভারতে বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। এটিই হলো ভারতের প্রধান বৃষ্টিপাতের ঋতু।

  • মৌসুমী বিস্ফোরণ: জুন মাসের প্রথম দিকে এই জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু হঠাৎ করে ভারতে প্রবেশ করলে বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়, যা 'মৌসুমী বিস্ফোরণ' নামে পরিচিত।
  • দুই শাখা: এই বায়ুপ্রবাহ দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে সারা দেশে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এর মধ্যে একটি হলো আরব সাগরীয় শাখা এবং অপরটি বঙ্গোপসাগরীয় শাখা
  • কৃষিতে প্রভাব: ভারতের কৃষি সম্পূর্ণরূপে এই বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, ভুট্টা, বাজরা প্রভৃতি খরিফ শস্য এই সময় চাষ করা হয়।
  • বৃষ্টির বন্টনে বৈচিত্র্য: মেঘালয়ের মৌসিনরাম (সর্বাধিক বৃষ্টিপাত) এবং রাজস্থানের থর মরুভূমি (সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত) এর মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের বন্টনে চরম বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

4. শরৎকাল:

সময়কাল: অক্টোবর মাস থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

বৈশিষ্ট্য: এই সময় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু ধীরে ধীরে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল থেকে পিছু হটে আসে। এই প্রক্রিয়াকে মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাগমন বলা হয়।

  • উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা: প্রত্যাগমনের প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তর ভারতের আকাশ পরিষ্কার হলেও দক্ষিণ ভারত ও উপকূলীয় অঞ্চলে তখনও তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং বাতাসের আর্দ্রতাও বেশি থাকে। এর ফলে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য খুব কম হয় এবং আবহাওয়া খুবই অস্বস্তিকর ও ভ্যাপসা লাগে। একেই 'অক্টোবর হিট' বলা হয়।
  • শীতকালীন বৃষ্টিপাত: এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়গুলির প্রভাবে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়। এই বায়ুপ্রবাহ বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে তামিলনাড়ুর উপকূলীয় অঞ্চলে এবং অন্ধ্রপ্রদেশের দক্ষিণ ভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায়।

ভারতের জলবায়ু অঞ্চল:

বিখ্যাত জার্মান আবহাওয়াবিদ ভ্লাদিমির কোপেন 1918 সালে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং উদ্ভিদের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের জলবায়ুকে শ্রেণীবদ্ধ করেন। কোপেন তাঁর পদ্ধতিটি পরে সংশোধন করেন যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর অধ্যয়নে বহুল প্রচলিত। ভারতেও এই শ্রেণীবিন্যাসটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য। তাই আমরা ভারতের জলবায়ুর 'কোপেন শ্রেণীবিভাগ' বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।

কোপেন তাঁর জলবায়ু শ্রেণীবিভাগে ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করে বিভিন্ন জলবায়ুকে চিহ্নিত করেছেন। ভারতে প্রধানত নিম্নলিখিত জলবায়ু প্রকারগুলি দেখা যায়:


koppen-climate-classification-map-of-India
ভারতের কোপেন জলবায়ু শ্রেণীবিভাগ


1. ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য জলবায়ু (Am):

A = ক্রান্তীয় জলবায়ু (Tropical Climate), m = মৌসুমী বায়ু দ্বারা প্রভাবিত।

অবস্থান: পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণ ভাগ (যেমন, গোয়া থেকে কেরালা পর্যন্ত) এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।

বৈশিষ্ট্য:

  • এই অঞ্চলে সারা বছরই উষ্ণতা বেশি থাকে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।এখানে একটি সংক্ষিপ্ত শুষ্ক ঋতু থাকে (সাধারণত শীতকালে), কিন্তু বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এতটাই বেশি যে শুষ্ক ঋতুতে আর্দ্রতার ঘাটতি অনুভূত হয় না।
  • মাসিক গড় তাপমাত্রা সর্বদা 18°C-এর উপরে থাকে।
  • এই অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ হলো ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃষ্টি অরণ্য।


2. ক্রান্তীয় সাভানা জলবায়ু (Aw):

A = ক্রান্তীয় জলবায়ু, w = শুষ্ক শীতকাল (Winter dry season)।

অবস্থান: পশ্চিম উপকূলের বাইরে অবস্থিত দাক্ষিণাত্য মালভূমির বেশিরভাগ অঞ্চল।

বৈশিষ্ট্য:

  • এখানে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, কিন্তু শীতকাল সম্পূর্ণ শুষ্ক থাকে। এটি ভারতের বৃহত্তম জলবায়ু অঞ্চল।
  • মাসিক গড় তাপমাত্রা সর্বদা 18°C-এর উপরে থাকে।
  • এই অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ হল সাভানা (Savanna) তৃণভূমি এবং পর্ণমোচী অরণ্য।

3. উষ্ণ মরু জলবায়ু (BWhw):

B = শুষ্ক জলবায়ু (Dry Climate), W = মরুভূমি (Desert), h = উষ্ণ (Hot), w= শুষ্ক শীতকাল।

অবস্থান: পশ্চিম রাজস্থানের বেশিরভাগ অংশ (যেমন, থর মরুভূমি)।

বৈশিষ্ট্য:

  • এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অত্যন্ত কম (বার্ষিক ২৫ সেমি-এর কম)।
  • গড় বাষ্পীভবনের হার বৃষ্টিপাতের তুলনায় অনেক বেশি।
  • গ্রীষ্মকাল অত্যন্ত উষ্ণ এবং শীতকাল মৃদু হয়।

4. উষ্ণ অর্ধ-শুষ্ক জলবায়ু (BShw):

B = শুষ্ক জলবায়ু, S = অর্ধ-শুষ্ক বা স্টেপ (Semi-arid or Steppe), h = উষ্ণ, w = শুষ্ক শীতকাল।

অবস্থান: রাজস্থানের পূর্বাংশ, গুজরাট, পাঞ্জাবের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং হরিয়ানার কিছু অংশ।

বৈশিষ্ট্য:

  • এই জলবায়ু অঞ্চলটি মরু জলবায়ু (BWhw) এবং আর্দ্র জলবায়ুর (Aw) মধ্যবর্তী স্থান দখল করে।
  • বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলেও তা মরুভূমির চেয়ে বেশি।
  • এখানে গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতকালে কম তাপমাত্রা অনুভূত হয়।
  • এই অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ হল কাঁটাযুক্ত গুল্ম ও স্টেপ তৃণভূমি।

5. উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু (Cwg):

C = নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু (Warm Temperate Climate), w = শুষ্ক শীতকাল, g = গঙ্গা।

অবস্থান: উত্তর ভারতের বেশিরভাগ সমভূমি অঞ্চল (পাঞ্জাব থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত গাঙ্গেয় সমভূমি)।

বৈশিষ্ট্য:

  • এখানে গ্রীষ্মকাল খুবই উষ্ণ হয় এবং শীতকাল শুষ্ক ও শীতল হয়।
  • বৃষ্টিপাত প্রধানত গ্রীষ্মকালে (মৌসুমী বায়ু দ্বারা) হয়ে থাকে।
  • কোপেন এই অঞ্চলকে 'গঙ্গা' (g) দ্বারা চিহ্নিত করেছেন, কারণ এটি গঙ্গা উপত্যকার জলবায়ুর প্রতিনিধিত্ব করে।

6. সংক্ষিপ্ত গ্রীষ্মের শীতল আর্দ্র জলবায়ু (Dfc):

D = মহাদেশীয় হিম জলবায়ু (Continental Cold Climate), f = কোনো শুষ্ক ঋতু নেই (Fully humid), c = অল্প গ্রীষ্মকাল।

অবস্থান: অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম এবং অসমের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল।

বৈশিষ্ট্য:

  • এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল সংক্ষিপ্ত এবং শীতল থাকে, এবং শীতকাল তীব্র দীর্ঘ হয়।
  • সারা বছরই বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত হয়।

7. মেরু জলবায়ু (ET) এবং উচ্চভূমি জলবায়ু (H):

E = মেরু জলবায়ু (Polar Climate), T = তুন্দ্রা (Tundra), H = উচ্চভূমি (Highland)।

অবস্থান: হিমালয় পর্বতমালার উচ্চতম শৃঙ্গগুলি (যেমন, কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ)।

বৈশিষ্ট্য:

  • ET (তুন্দ্রা): এই জলবায়ুতে উষ্ণতম মাসের গড় তাপমাত্রা 0°C থেকে 10°C-এর মধ্যে থাকে। এখানে কোনো সত্যিকারের গ্রীষ্মকাল থাকে না।
  • উচ্চভূমি (H): এই শ্রেণীবিভাগটি উচ্চতা-নিয়ন্ত্রিত জলবায়ুকে বোঝায়, যেখানে তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস পায় এবং প্রায়শই চিরস্থায়ী তুষারপাত দেখা যায়। এই জলবায়ু অঞ্চলটি স্থায়ী বরফের রেখার উপরে অবস্থিত।

8. ক্রান্তীয় শুষ্ক গ্রীষ্মকালীন জলবায়ু (As):

A = ক্রান্তীয় জলবায়ু, s = শুষ্ক গ্রীষ্মকাল (Summer dry season)।

অবস্থান: তামিলনাড়ুর করোমণ্ডল উপকূল।

বৈশিষ্ট্য:

  • এটি একটি বিরল ব্যতিক্রম। গ্রীষ্মকালে যখন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সারা ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তখন এই অঞ্চলটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে থাকার কারণে শুষ্ক থাকে।
  • বৃষ্টিপাত প্রধানত শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু বা প্রত্যাগমনকারী মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে হয়।

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post