ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগ গুলির বর্ণনা

আয়তন অনুসারে ভারতবর্ষ বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের প্রায় 2.42% ভারতের অন্তর্গত। তাই ভারতের ভূ-প্রকৃতিতে রয়েছে এক বিশাল বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য অনুযায়ী ভারতের ভূ-প্রকৃতিকে প্রধানত ছয়টি ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগে ভাগ করা যায়। যথা: 1) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল, 2) উত্তরের সমভূমি অঞ্চল, 3) উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল, 4) ভারতের মরুভূমি অঞ্চল, 5) উপকূলের সমভূমি অঞ্চল, 6) দ্বীপপুঞ্জ।


india-physical-divisions-map
ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগের মানচিত্র


1. উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল:

ভারতের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলটি প্রধানত নবীন ভঙ্গিল পর্বতমালা হিমালয় দ্বারা গঠিত। এটি লাদাখ এবং জম্মু ও কাশ্মীর থেকে শুরু করে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় 2500 কিলোমিটার বিস্তৃত। আর এই অঞ্চলেই অবস্থান করেছে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশ্রেণী হিমালয়। এই অঞ্চলটি কেবল ভারতের জলবায়ু, নদনদী এবং অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলে না, এটি দেশের প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসেবেও কাজ করে। এই পর্বতমালাই সাইবেরিয়ান শীতল জলবায়ু থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করে। ​ভারতের এই পার্বত্য অঞ্চলকে প্রধানত দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আলোচনা করা যায়। যথা: i) হিমালয়ের সমান্তরাল পর্বতশ্রেণী, ii) হিমালয়ের আঞ্চলিক বিভাগ।


i) হিমালয়ের সমান্তরাল পর্বতশ্রেণী:

হিমালয়ের সমান্তরাল পর্বত শ্রেণীকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:


a) ট্রান্স-হিমালয় বা তিব্বতীয় হিমালয়:

প্রধান বৈশিষ্ট্য: বৃহত্তর হিমালয়ের উত্তরে ট্রান্স-হিমালয় বা তিব্বতীয় হিমালয় অংশটি অবস্থিত। এটি হিমালয়ের সবচেয়ে প্রাচীন অংশ। এটিকে টেথিস হিমালয়ের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা প্রায় 5800 মিটার। এই অঞ্চলের জলবায়ু অত্যন্ত শুষ্ক এবং শীতল প্রকৃতির। গ্রীষ্মকালে সামান্য তাপমাত্রা বাড়লেও শীতকালে তীব্র ঠান্ডা পরে। হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের মধ্যে পড়ায় এখানে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য গিরিপথগুলির মধ্যে রয়েছে খারদুংলা গিরিপথ, আঘিল গিরিপথ এবং কারাকোরাম গিরিপথ

গুরুত্বপূর্ণ পর্বতশ্রেণী: ট্রান্স-হিমালয় প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বতশ্রেণী নিয়ে গঠিত। যথা: কারাকোরাম পর্বতশ্রেণী, জাস্কর পর্বতশ্রেণী, লাদাখ পর্বতশ্রেণী। কারাকোরাম পর্বতশ্রেণী হলো হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী। কারাকোরাম পর্বতমালায় অবস্থিত মাউন্ট গডউইন অস্টিন হল ভারতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ভারতের দীর্ঘতম হিমবাহ সিয়াচেন কারাকোরাম পর্বতমালাতেই অবস্থিত।


b) গ্রেটার হিমালয় বা হিমাদ্রি হিমালয়:

হিমালয় পর্বতমালার তিনটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণীর মধ্যে হিমাদ্রি হিমালয় হলো সর্বোচ্চ অংশ। এটি ট্রান্স-হিমালয় বা তিব্বতীয় হিমালয়ের দক্ষিণে এবং হিমাচল বা মধ্য হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত। এটিকে হিমালয় পর্বতমালার মূল অক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর গড় উচ্চতা প্রায় 6000 মিটার। এটি পশ্চিমে নঙ্গা পর্বত (জম্মু ও কাশ্মীর) থেকে পূর্বে নামচা বারওয়া (তিব্বত-অরুণাচল সীমান্ত) পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি প্রধানত আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলা যেমন গ্রানাইট, নিস ও সিস্ট শিলা দ্বারা গঠিত। এর বেশিরভাগ অংশই চিরতুষারাবৃত থাকে, তাই একে 'হিমাদ্রি' বলা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলেই অবস্থান করেছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। নেপালী ভাষায় মাউন্ট এভারেস্টকে 'সাগরমাথা' (আকাশের দেবী) বলা হয়। এছাড়া তিব্বতে এভারেস্ট 'চোমোলাংমা' নামে পরিচিত। হিমাদ্রি অংশটিতে অসংখ্য ছোট-বড় হিমাবাহুও রয়েছে। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হিমবাহ হল গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, জেঁমু ইত্যাদি। অত্যন্ত উঁচু ও দুর্গম হাওয়াই এই অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু গিরিপথ। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গিরিপথ হল:

  • জোজি-লা:কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে লাদাখের সংযোগকারী,
  • ​শিপকি-লা: হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে তিব্বতের সংযোগকারী,
  • ​বারালাচা-লা: হিমাচল প্রদেশকে লাদাখের সঙ্গে যুক্ত করে,
  • ​নাথু-লা ও জেলেপ-লা: সিকিমের সঙ্গে তিব্বতের সংযোগকারী।

হিমাদ্রির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্বতশৃঙ্গ হলো:

শৃঙ্গের নাম উচ্চতা (মিটার) অবস্থান
মাউন্ট এভারেস্ট 8,848.86 নেপাল-চীন (তিব্বত)
কাঞ্চনজঙ্ঘা 8,586 ভারত-নেপাল
লোৎসে 8,516 নেপাল-চীন (তিব্বত)
মাকালু 8,485 নেপাল-চীন (তিব্বত)
ধৌলাগিরি 8,167 নেপাল
নাঙ্গা পর্বত 8,126 পাকিস্তান-ভারত (PoK)
অন্নপূর্ণা 8,091 নেপাল
নন্দা দেবী 7,816 ভারত (উত্তরাখণ্ড)


c) লেসার হিমালয় বা হিমাচল হিমালয়:

এটি গ্রেটার হিমালয়ের দক্ষিণে এবং শিবালিক হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত। এর উচ্চতা গ্রেটার হিমালয়ের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। এর গড় উচ্চতা প্রায় ৪,৫০০ মিটার। এটি প্রধানত গ্রানাইট, রূপান্তরিত পাললিক শিলা এবং কোয়ার্টজাইট শিলা দ্বারা গঠিত। গ্রেটার হিমালয় থেকে আসা নদীগুলির তীব্র ক্ষয়কার্যের ফলে এটি বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপত্যকা হল কাশ্মীর উপত্যকা, কাংড়া ও কুলু উপত্যকা, কাঠমান্ডু উপত্যকা ইত্যাদি। হিমাচল হিমালয় তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্যকর জলবায়ুর জন্য বিখ্যাত। শীতকালে তুষারপাত হলেও এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা বেশ আরামদায়ক। জলবায়ু মনোরম এবং নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতির হওয়ায় এই অঞ্চল শৈলশহর সৃষ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশ। শ্রীনগর, শিমলা, মানালি নৈনিতাল, মুসৌরি, দার্জিলিং, কালিম্পং ইত্যাদি শৈলশহর গুলি এই লেজার হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত। এই অংশে পর্বতমালার ঢালে ছোট ছোট ঘাস ও গুল্ম দ্বারা গঠিত তৃণভূমি দেখা যায়। কাশ্মীরে এই তৃণভূমিগুলিকে 'মার্গ' (যেমন: গুলমার্গ, সোনামার্গ) এবং উত্তরাখণ্ডে 'বুগিয়াল' বা 'পায়াড়' বলা হয়।

হিমাচল হিমালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বতশ্রেণী:

পর্বতশ্রেণীর নাম অবস্থান
পীর পাঞ্জাল জম্মু ও কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশ
ধৌলাধর হিমাচল প্রদেশ
মুসৌরি রেঞ্জ উত্তরাখণ্ড
নাগটিব্বা উত্তরাখণ্ড ও নেপাল


d) আউটার হিমালয় বা শিবালিক হিমালয়:

শিবালিক হিমালয় অংশটি হিমাচল বা মধ্য হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত এবং সিন্ধু সমভূমির উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি হিমালয়ের তিনটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণীর মধ্যে সর্বনিম্ন অংশ। এর গড় উচ্চতা প্রায় 1,200 মিটার। এটি তুলনামূলকভাবে নবীন এবং প্রধানত মধ্য হিমালয় থেকে আগত নদী ও হিমবাহ দ্বারা বাহিত পলি, নুড়ি, কাঁকর এবং সূক্ষ্ম শিলাখণ্ড দ্বারা গঠিত। গঠন দুর্বল হয়ে কারণে এখানে ভূমিধস এবং ভূমিকম্পের প্রবণতা বেশি। শিবালিক হিমালয় অংশটি জম্মু অঞ্চলে 'জম্মু পাহাড়' এবং ​উত্তরাখণ্ডে 'দুন্ডওয়া রেঞ্জ' বা 'চুরিয়া ঘাট' নামে পরিচিত। শিবালিক হিমালয় এবং হিমাচল হিমালয়ের মাঝখানে কিছু অনুদৈর্ঘ্য উপত্যকা দেখা যায়, যা শিবালিক অঞ্চলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিবালিকের পশ্চিমে এই উপত্যকাগুলিকে 'দুন' বলা হয়। এগুলি মূলত নদী দ্বারা জমা হওয়া মোটা নুড়ি-কাঁকর এবং পলি দিয়ে গঠিত। যেমন: দেরাদুন (সবচেয়ে বড় দুন), কোটলি দুন, পাটলি দুন ইত্যাদি। শিবালিকের পূর্ব অংশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের নিকটবর্তী অঞ্চলে, এই উপত্যকাগুলিকে 'দুয়ার' বলা হয়। এই দুয়ার অঞ্চলগুলি চা চাষের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া, দুয়ার অঞ্চল গুলি উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে।


e) পূর্বাঞ্চল বা পূর্বের পার্বত্য অঞ্চল:

পূর্বাঞ্চল বা পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলটি পূর্বাঞ্চল পর্বতশ্রেণী নামেও পরিচিত। এটি হিমালয় পর্বতমালার পূর্ব দিকের সেই অংশ যা হিমালয় থেকে দক্ষিণমুখী বাঁক নিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির (অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা) উপর দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। এই অঞ্চলটি পাটকাই-নাগা-লুসাই পর্বতশ্রেণী নামেও পরিচিত। মধ্য হিমালয়ের তুলনায় এই পর্বতের উচ্চতা অনেক কম। এর গড় উচ্চতা সাধারণত 1,500 মিটার থেকে 3,000 মিটার-এর মধ্যে থাকে। এটি প্রধানত পাললিক শিলা এবং স্থানীয় রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। পূর্বাঞ্চল পর্বতশ্রেণীকে মূলত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

  • পাটকাই পর্বতশ্রেণী: এটি অরুণাচল প্রদেশ এবং নাগাল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বরাবর অবস্থিত এবং ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে সীমানা তৈরি করেছে। এর দুটি ​প্রধান অংশ হলো পাটকাই-বুম ও ​নাগা পর্বত। নাগাল্যান্ডের নাগা পর্বতে অবস্থিত সারামতি (3,841 মিটার) হলো এখানকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
  • মণিপুর পর্বতশ্রেণী: এটি নাগাল্যান্ডের দক্ষিণে মণিপুর রাজ্যের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। এখানে বিখ্যাত লোকটাক হ্রদ অবস্থিত, যা ফুমদি (Floating Islands)-এর জন্য বিখ্যাত।
  • মিজো ও ত্রিপুরা পর্বতশ্রেণী: এটি মিজোরাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত। মিজোরামের মিজো পাহাড় আগে লুসাই পাহাড় নামে পরিচিত ছিল। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল নীল পর্বত বা ফাংপুই (2157 মিটার)


ii) হিমালয়ের আঞ্চলিক বিভাগ:

স্যার সিডনি বুরার্ড, প্রধান নদী উপত্যকা গুলির ভিত্তিতে সমগ্র হিমালয়কে পশ্চিম থেকে পূর্বে মোট চারটি আঞ্চলিক বিভাগকে বিভক্ত করেন। ভাগগুলি হলো:


a)পাঞ্জাব হিমালয়:

এটি হলো পশ্চিমে সিন্ধু নদী এবং পূর্বে শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী অংশ। এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় 560 কিলোমিটার। প্রধানত জম্মু ও কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশে বিস্তৃত বলে এই অঞ্চলটি কাশ্মীর হিমালয় বা হিমাচল হিমালয় নামেও পরিচিত। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্বতশ্রেণী হলো কারাকোরাম, লাদাখ, পীর পাঞ্জাল, জাংস্কার, ধৌলাধর ইত্যাদি। জোজি লা, বানিহাল, রোথাং ইত্যাদি গিরিপথগুলি এই অঞ্চলের অন্তর্গত। এছাড়াও এই অঞ্চলে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হ্রদ, যেমন- ডাল, উলার, প্যাংগং সো, সো মরিরি ইত্যাদি।


b) কুমায়ুন হিমালয়:

এটি শতদ্রু নদী এবং কালী নদীর মধ্যবর্তী অংশ। এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় 320 কিলোমিটার। এটি হলো আঞ্চলিক বিভাগগুলির মধ্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতম বিভাগ। প্রধানত উত্তরাখণ্ড রাজ্যে অবস্থিত হওয়ায় এটি উত্তরাখণ্ড হিমালয় নামেও পরিচিত। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্বত শৃঙ্গ হল- নন্দা দেবী, কামেত, ত্রিশূল, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ ইত্যাদি। বিখ্যাত গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী হিমবাহ দুটিও এই অঞ্চলে এই অবস্থান করেছে।


c) নেপাল হিমালয়:

এটি হলো কালী নদী ও তিস্তা নদীর মধ্যবর্তী অংশ। এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় 800 কিলোমিটার। হিমালয়ের আঞ্চলিক বিভাগগুলির মধ্যে এটি হলো দীর্ঘতম বিভাগ। বিশ্বের বেশিরভাগ উঁচু উঁচু পর্বত শৃঙ্গ গুলি এই অঞ্চলে অবস্থান করেছে। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্বত শৃঙ্গ হল- মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ধৌলা, অন্নপূর্ণা, মাকালু ইত্যাদি।


d) আসাম হিমালয়:

এটি তিস্তা নদী এবং ডিহাং নদীর মধ্যবর্তী অংশ। এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় 750 কিলোমিটার। এটি নেপাল হিমালয়ের পরেই দ্বিতীয় দীর্ঘতম আঞ্চলিক বিভাগ। এই অঞ্চলটি সিকিম থেকে অরুণাচল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্বত শৃঙ্গ হল- নামচা বারওয়া, কুল্লু, কাঙ্গোরি, চামোলার প্রভৃতি।


2. উত্তরের সমভূমি অঞ্চল: 

উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলটি মূলত সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি বৃহৎ নদী এবং তাদের অসংখ্য উপনদীর  পলি সঞ্চয়ের ফলে গঠিত হয়েছে। এই সমভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম পলি গঠিত সমভূমিগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি হিমালয়ের শিবালিক পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণে এবং উপদ্বীপীয় মালভূমির উত্তরে একটি অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতি নিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 50 মিটার থেকে 300 মিটারের মধ্যে। সমভূমির গঠন ও ভূমির প্রকৃতি অনুসারে এই অঞ্চলকে উত্তর থেকে দক্ষিণে চারটি উপ-অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা:


i) ভাবর :

এই অঞ্চলটি শিবালিক পর্বতমালার ঠিক পাদদেশে অবস্থিত। অঞ্চলটি প্রায় 8 থেকে 16 কিমি চওড়া। এটি প্রধানত নুড়ি, বালি, পাথর এবং শিলাখণ্ড দ্বারা গঠিত। হিমালয়ের নদীগুলি যখন পর্বত থেকে সমভূমিতে নেমে আসে, তখন সমস্ত বড় ও ভারী পদার্থগুলি এই অঞ্চলে এসে সঞ্চিত হয়। অঞ্চলটির ভূমিরূপের আকৃতি ঈষৎ ঢেউ খেলানো। এই অঞ্চলে নদীগুলি কোথাও কোথাও ভূগর্ভস্থভাবে প্রবাহিত হয়। ভূমি নুড়ি-পাথর যুক্ত হওয়ায় অঞ্চলটির মাটির স্তর খুব পাতলা। তাই এই অঞ্চলটি কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নয়।


ii) তরাই:

তরাই অঞ্চলটি ভাবর অঞ্চলের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত। এটি প্রায় 15 থেকে 30 কিলোমিটার চওড়া। তোরাই কথার অর্থ হল 'স্যাঁতস্যাঁতে' ভূমি। তরাই অঞ্চলটি প্রধানত সূক্ষ্ম পলি, কাদা এবং বালি দ্বারা গঠিত। এখানকার ভূমি সামান্য ঢালু এবং পৃষ্ঠতল অসমান। এই অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। ভাবর অঞ্চলে ভূগর্ভে চলে যাওয়া নদীগুলি এই অঞ্চলে এসে আবার ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসে। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে বর্তমানে এই অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় ধান, গম, আখ ইত্যাদি ফসল চাষ হচ্ছে।


iii) ভাঙ্গর:

এই অঞ্চলটি তরাই অঞ্চলের দক্ষিণে এবং নদীর বর্তমান বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত। এটি সাধারণত পুরাতন বা উচ্চ সমভূমি হিসেবে পরিচিত। এটি মূলত প্রাচীন পলিমাটি দ্বারা গঠিত। ভাঙ্গর অঞ্চলটি খাদার অঞ্চল থেকে গড়ে প্রায় 30 মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ​এই অঞ্চলে মাটির মধ্যে চুনাপাথরের নুড়ি দেখা যায়, যা 'কাঁকর' নামে পরিচিত। এই কাঁকর মাটির উর্বরতা কিছুটা হ্রাস করে। সেচের সাহায্যে এই অঞ্চলে গম, আখ, তৈলবীজ ইত্যাদি বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়।


iv) খাদার:

এই অঞ্চলটি উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলের নদী তীরবর্তী নিচু অঞ্চলে বা বন্যার সমভূমিতে অবস্থিত। ​এটি নতুন পলিমাটি দ্বারা গঠিত। প্রতি বছর বন্যার সময় নদীগুলি এই অঞ্চলে নতুন পলিমাটি সঞ্চিত করে। অঞ্চলটি মূলত সূক্ষ্ম পলি, কাদা ও বালি দিয়ে গঠিত। এতে চুনাপাথরের নুড়ি বা কাঁকর প্রায় থাকে না বললেই চলে। খাদার অঞ্চলটি হল উত্তরের সমভূমির অঞ্চলের সবচেয়ে উর্বর অংশ। তাই উচ্চ উর্বরতার কারণে এই অঞ্চল কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধান, পাট, গম, ডাল এবং তৈলবীজ এখানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। খাদার অঞ্চলটি পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে 'বেট' নামে পরিচিত।


3. উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল:

উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলটি ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগগুলির মধ্যে বৃহত্তম ও প্রাচীনতম অংশ। এটি প্রাচীন গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের অংশ। এই অঞ্চলটি প্রধানত প্রাচীন আগ্নেয় (গ্রানাইট ও ব্যাসল্ট) এবং রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। এর গড় উচ্চতা প্রায় 900 মিটার। এটি ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত স্থিতিশীল অঞ্চল। মালভূমিটির আকৃতি অনেকটা একটি উল্টানো ত্রিভুজের মতো। এই অঞ্চলের অধিকাংশ নদীর গতিপথ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে হওয়ায় বোঝা যায় এর সাধারণ ঢাল পূর্বমুখী। ​ভূ-প্রকৃতি অনুসারে উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:


i) কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি:

উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলের উত্তরাংশকে কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি বলা হয়। এটি মূলত নর্মদা নদীর উত্তর দিক থেকে, পশ্চিমে আরাবল্লী পর্বত এবং পূর্বে ছোটনাগপুর মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত। কেন্দ্রীয় উচ্চভূমিটি প্রধানত প্রাচীন আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলা যেমন গ্রানাইট এবং নিস দ্বারা গঠিত। ​ভূ-প্রকৃতি অনুসারে কেন্দ্রীয় উচ্চভূমির প্রধান কয়েকটি ভাগ হল:


a) আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী:

এটি কেন্দ্রীয় উচ্চভূমির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। পৃথিবীর প্রাচীনতম ভঙ্গিল পর্বতমালাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এটি রাজস্থানের মধ্য দিয়ে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত। মাউন্ট আবুতে অবস্থিত 'গুরু শিখর' (1,722 মিটার) হলো এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এটি রাজস্থানের পশ্চিমে শুষ্ক থর মরুভূমি এবং পূর্বে অপেক্ষাকৃত উর্বর অঞ্চলের মধ্যে একটি জলবিভাজিকার কাজ করে।


b) মালব মালভূমি:

এটি আরাবল্লীর দক্ষিণ-পূর্বে এবং বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরে অবস্থিত। প্রধানত মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান রাজ্যে এটি বিস্তৃত হয়েছে। এর উত্তর-পশ্চিম অংশটি ডেকান ট্র্যাপের ব্যাসল্ট দ্বারা গঠিত। তাই এখানে কৃষ্ণ মৃত্তিকা দেখা যায়। চম্বল, কালী সিন্ধ, বেতোয়া এবং নর্মদা নদীগুলি হলো এই অঞ্চলের প্রধান নদী।


c) বুন্দেলখণ্ড:

এই অঞ্চলটি যমুনা নদীর দক্ষিণ এবং মালব মালভূমির উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। মূলত উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন অংশে এই অঞ্চলটি বিস্তৃত। এটি গ্রানাইট ও নিস শিলা দ্বারা গঠিত। অঞ্চলটি দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার কারণে  এখানে গভীর গভীর গিরিখাত দেখা যায়।


​d) বাঘেলখণ্ড:

এই অঞ্চলটি বুন্দেলখণ্ডের পূর্ব দিকে এবং মৈকাল পর্বতশ্রেণীর উত্তরে অবস্থিত। এখানকার প্রধান নদী হল শোন নদী


​e) ছোটনাগপুর মালভূমি:

এটি কেন্দ্রীয় উচ্চভূমির পূর্বতম অংশ। ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন অংশে এই অঞ্চলটি বিস্তৃত। এই অঞ্চলে দামোদার নদীর উপত্যকা দিয়ে প্রধান মালভূমিটি বিভক্ত হয়েছে। এটি ভারতের খনিজ সম্পদের ভান্ডার হিসেবে বিখ্যাত। বিশেষ করে কয়লা ও লৌহ আকরিক এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই কারণে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলটিকে "ভারতের রূঢ়" বলা হয়।


ii) দাক্ষিণাত্য মালভূমি:

দাক্ষিণাত্য মালভূমি হল উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলের বৃহত্তম ও প্রধান অংশ। এটি ভারতের দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি সুবিশাল, ত্রিকোণাকার ভূমিভাগ। এর আকার একটি উল্টানো ত্রিভুজের মতো। এটি প্রাচীন আগ্নেয় (গ্রানাইট, ব্যাসল্ট) এবং রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। এই অঞ্চলে ভূমির ঢাল সাধারণত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে।  যার ফলে অধিকাংশ নদী (গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী) পশ্চিমঘাট থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। দাক্ষিণাত্য মালভূমির সীমানা বরাবর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বতশ্রেণী রয়েছে। যথা:


a) সাতপুরা পর্বতশ্রেণী:

এটি দাক্ষিণাত্য মালভূমির উত্তর সীমায় নর্মদা ও তাপ্তি নদীর মাঝখানে অবস্থিত। পাঁচমারি-তে অবস্থিত ধূপগড় (1,350 মিটার) হলো এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।


​b) পশ্চিমঘাট পর্বতমালা:

এটি মালভূমির পশ্চিম প্রান্তে আরব সাগরের সমান্তরালে অবস্থিত। অঞ্চলটি গুজরাটের তাপ্তি নদীর দক্ষিণ ভাগ থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটক, কেরালা হয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি মালভূমির একটি খাড়া ঢাল বা চ্যুতিপ্রান্তে গঠিত। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা স্থানীয়ভাবে 'সহ্যাদ্রি' নামে পরিচিত। অঞ্চলটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে এবং বিশ্বের অন্যতম আটটি 'হটস্পট অফ বায়োডাইভার্সিটি' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি এই পশ্চিমঘাট পর্বতমালা থেকেই উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ 'আনাইমুদি' (2,695 মিটার) হলো দক্ষিণ ভারতেরও সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা নীলগিরি পর্বতের মাধ্যমে পূর্বঘাট পর্বতমালার সাথে মিলিত হয়েছে। নীলগিরি পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল দোদাবেতা (2,637 মিটার)। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে। যার ফলে, পশ্চিম ঢালে মুম্বাই ও কেরালার মতো অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে পর্বতের পূর্ব ঢালটি মৌসুমী বায়ুর দিক থেকে আড়ালে থাকায় সেটি পরিণত হয়েছে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা নিরবচ্ছিন্ন হওয়ায় যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ। সেগুলি হলো:

  • থালঘাট: নাসিক ও মুম্বাইয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে।
  • পালঘাট: মুম্বাই ও পুণের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে।
  • ভোরঘাট: কোয়েম্বাটুর এবং কোচির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে।
  • সেনকোত্তা গ্যাপ: মাদুরাই ও তিরুবনন্তপুরমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে।

​c) পূর্বঘাট পর্বতমালা:

​পূর্বঘাট পর্বতমালা হলো উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত পর্বতশ্রেণী। অঞ্চলটি উড়িষ্যার মহানদী উপত্যকা থেকে শুরু করে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা হয়ে দক্ষিণে তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পশ্চিমঘাট পর্বতমালার তুলনায় কম উচ্চতাযুক্ত। এর গড় উচ্চতা প্রায় 600 মিটার। অঞ্চলটি মূলত প্রাচীন রূপান্তরিত শিলা (কোয়ার্টজাইট, খন্ডালাইট, এবং চারনোকাইট) দ্বারা গঠিত। মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, ও কাবেরীর মতো বড় নদীগুলি এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত আরমা কোন্ডা (1,680 মিটার) বা জিন্দাগাড়া হলো পূর্বঘাট পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।


4. ভারতের মরুভূমি অঞ্চল:

ভারতের মরু অঞ্চলটি মূলত থর মরুভূমি বা গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট নিয়ে গঠিত। এটি ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং বিশ্বের নবম বৃহত্তম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি। অঞ্চলটি প্রধানত রাজস্থান রাজ্যের আরাবল্লী পর্বতমালার পশ্চিমে অবস্থিত। এটি উত্তরে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা, পূর্বে আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী, পশ্চিমে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ এবং দক্ষিণে গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত। এই মরুভূমির মোট আয়তন প্রায় 2,00,000 বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় 85% ভারতেই অবস্থিত।


i) ভূ-প্রকৃতি:

ভূ-প্রকৃতি অনুসারে ​থর মরুভূমিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

  • মরুস্থলী: এটি থর মরুভূমির মূল অংশ এবং সম্পূর্ণভাবে শুষ্ক প্রকৃতির। এই অঞ্চলে বালি ও নুড়ি পাথরের ঢিবি বা বালিয়াড়ি  প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। এই বালিয়াড়িগুলি আবার বাতাসের প্রভাবে স্থান পরিবর্তন করেও থেকে।
  • বাগর: এটি মরুস্থলীর পূর্ব দিকে আরাবল্লী পর্বতের কাছাকাছি অবস্থিত। এই অঞ্চলটি তুলনামূলকভাবে কম শুষ্ক। এখানে প্রাচীন পলিমাটি এবং কম উচ্চতার টিলা দেখা যায়। স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে কিছু কিছু ঘাস ও গুল্ম জন্মায়।


ii) নদী ও হ্রদ:

এই অঞ্চলের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো লুনি। এটি আরাবল্লী পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে থর মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং তারপর কচ্ছের রণে গিয়ে বিলীন হয়েছে। এই নদীটি বর্ষাকালে মিষ্টি জল বহন করলেও মরু অঞ্চলের লবণাক্ত মাটির কারণে অন্য সময়ে এর জল ক্রমশ নোনা হতে থাকে। এছাড়া, মরুভূমির অভ্যন্তরে বেশ কিছু নোনা জলের হ্রদ দেখা যায়। যেমন- সম্বর হ্রদ, ডিডওয়ানা, পঞ্চপদ্রা ইত্যাদি।


iii) জলবায়ু:

অঞ্চলটির জলবায়ু উষ্ণ ও শুষ্ক প্রকৃতির। এখানে দৈনিক এবং বার্ষিক তাপমাত্রা চরমভাবাপন্ন হয়। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা 50° সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এবং শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনেক সময় 5° সেলসিয়াসেরও নিচে নেমে যায়। এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 15 সেমির থেকেও কম। এর প্রধান কারণ হল এটি পশ্চিমঘাট ও আরাবল্লী পর্বতমালার বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে অবস্থিত।


iv) স্বাভাবিক উদ্ভিদ:

জলবায়ু শুষ্ক প্রকৃতির হওয়ায় এখানে বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিক্ষ খুব কম দেখা যায়। তবে এখানে কিছু বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ জন্মায় যারা রুক্ষ পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম। এই উদ্ভিদ গুলিকে জেরোফাইট বা মরু উদ্ভিদ বলা হয়। এই অঞ্চলে সাধারণত বাবলা, ক্যাকটাস, খেজুর, কেকরো, আকেশিয়া, রোহিদা ইত্যাদি উদ্ভিদগুলি দেখা যায়।


v) কৃষি:

আগে এই অঞ্চলের কৃষিকাজ ছিল খুবই সীমিত। তবে 'ইন্দিরা গান্ধী ক্যানেল' নির্মাণের পর রাজস্থানের উত্তর-পশ্চিম অংশে সেচ সুবিধা পৌঁছেছে। যার ফলে কিছু এলাকায় এখন গম ও তুলার চাষ সম্ভব হয়েছে।


5. উপকূলের সমভূমি অঞ্চল:

ভারতের উপকূলের সমভূমি অঞ্চলটি উপদ্বীপীয় মালভূমি এবং সমুদ্রের মাঝখানে অবস্থিত একটি সংকীর্ণ সমতল ভূমি। ভারত প্রায় 7,500 কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই উপকূলীয় সমভূমিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:


i) পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমি:

আরব সাগরের তীরবর্তী এই সমভূমিটি গুজরাট থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ এবং পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত। এটি গড়ে প্রায় 50-80 কিলোমিটার চওড়া এবং প্রায় 1840 কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি মূলত চ্যুতি এবং নিমজ্জনের ফলে গঠিত। এর বেশিরভাগ স্থাননেই খাঁজকাটা এবং নদীমোহনা  দেখা যায়। এই অঞ্চলের নদীগুলি (যেমন নর্মদা ও তাপ্তি) ছোট এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন, যা নদীমোহনা তৈরি করে, কিন্তু বড় ব-দ্বীপ তৈরি করে না। পশ্চিম উপকূলে উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত আঞ্চলিক বিভাগগুলি হল কচ্ছ উপসাগর, খাম্বাত উপসাগর কঙ্কন  উপকূল এবং মালাবার উপকূল।


ii) পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি:

বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই সমভূমিটি মহানদী নদীর মুখ থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পশ্চিম উপকূলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি চওড়া ও প্রশস্ত। এর গড়ে প্রায় 100-120 কিলোমিটার চওড়া এবং প্রায় 1800 কিলোমিটার দীর্ঘ। ​অঞ্চলটি মূলত মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ইত্যাদি নদীগুলির বয়ে আনা পলি জমা হয়ে গঠিত। ​এই নদীগুলি এই অঞ্চলে বড় ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে, যা এই অঞ্চলকে অত্যন্ত উর্বর করে তুলেছে। এখানে প্রচুর উপহ্রদ বা লেগুন দেখা যায়। পূর্ব উপকূলে উত্তর থেকে দক্ষিনে করমন্ডল উপকূল, পক প্রণালী এবং মান্নার উপসাগর অবস্থান করেছে।


6. ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ:

ভারতের মূল ভূখণ্ডের উপকূলরেখা ছাড়াও বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে অবস্থিত দুটি বৃহৎ দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জগুলি ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগগুলির মধ্যে একটি স্বতন্ত্র স্থান দখল করে আছে। দ্বীপপুঞ্জ গুলি হলো:

i) আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ:

এটি হলো ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এটি বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এই দ্বীপগুলি মূলত নিমজ্জিত পর্বতের চূড়া। এটি হিমালয় পর্বতমালার আরাকান ইয়োমা পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণ দিকে সমুদ্রের নিচে প্রসারিত অংশ। এখানে প্রায় 572টি ছোট-বড় দ্বীপ রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি হলো আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ (উত্তরের অংশ) এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ (দক্ষিণের অংশ)। 'দশ ডিগ্রি চ্যানেল' বা 10°N অক্ষরেখার একটি প্রণালী আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে আলাদা করেছে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী হলো পোর্ট ব্লেয়ার। ভারতের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণতম বিন্দু কন্যাকুমারিকা হলেও, ভারতের সর্বদক্ষিণ বিন্দু হলো নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের 'ইন্দিরা পয়েন্ট'। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত স্যাডল পিক (732 মিটার) হলো এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ভারতের একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ব্যারেন দ্বীপ এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এছাড়াও এখানে রয়েছে অন্যতম সুপ্ত আগ্নেয়গিরি নারকোন্ডাম দ্বীপও। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি হওয়ায় এই অঞ্চলের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। এখানে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টিপাত হয়। তাই এখানে প্রধানত চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি দেখা যায়। জারোয়া, ওঙ্গি, সেন্টিনেলিজ, এবং নিকোবরী সহ বেশ কিছু আদিম উপজাতির মানুষ এখানে বসবাস করে।


ii) লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ:

লাক্ষাদ্বীপও ভারতের অন্যতম একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এটি আরব সাগরে অবস্থিত। এই দ্বীপপুঞ্জ প্রধানত প্রবাল দ্বারা গঠিত। এখানে মোট 36টি দ্বীপ রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র 11টিতে জনবসতি রয়েছে। এটি কেরালা উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত। 1973 সালে লাক্ষাদ্বীপ, মিনিকয় এবং আমিনদিভি দ্বীপপুঞ্জ  একত্রিত হয়ে লাক্ষাদ্বীপ নামে পরিচিত হয়। লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী হল কাভারাত্তি। এই দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বৃহত্তম দ্বীপ মিনিকয়। মিনিকয় দ্বীপ ও লাক্ষাদ্বীপকে আলাদা করেছে 9° চ্যানেল। এখানকার জলবায়ু আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মতোই উষ্ণ ও আর্দ্র। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হলো নারকেল চাষ, মাছ ধরা এবং প্রবাল থেকে চুন উৎপাদন। এই অঞ্চলে পর্যটনও খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে।

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post