সিন্ধু সভ্যতা হল ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উন্নত তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন। এটি ছিল একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। এটি প্রধানত সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলির অববাহিকা অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র হল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো। হরপ্পা কথার অর্থ হল পশুপতির খাদ্য। এবং মহেঞ্জোদারো কথার অর্থ হল মৃতের স্তুপ।
1. সিন্ধু সভ্যতার পরিচিতি ও সময়কাল
- নামকরণ: এই সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। প্রথম আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হরপ্পার নামানুসারে প্রথমে এই সভ্যতা 'হরপ্পা সভ্যতা' নামে পরিচিত হয়। এরপর মহেঞ্জোদারো ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র গুলি একে একে আবিষ্কার হয়েছিল। যেগুলির মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সিন্ধু ও তার উপনদী গুলির অববাহিকা অঞ্চল জুড়ে। তাই পরবর্তীতে এই সভ্যতার নামকরণ হয় সিন্ধু সভ্যতা।
- সময়কাল: আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে এই সভ্যতার সূচনা, বিস্তার ও অবলুপ্তি ঘটে।
- আবিষ্কার: সিন্ধু সভ্যতার প্রধান দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র হলো হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক দয়ারাম সাহানি বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মন্টেগোমারি জেলায় এই সভ্যতার প্রথম কেন্দ্র হরপ্পা আবিষ্কার করেন। এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশের লারাকানা জেলায় মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেন। স্যার জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে এই খননকার্য শুরু হয়।
- ভৌগোলিক বিস্তার: এই সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতা গুলির মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তর অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সিন্ধু সভ্যতা আয়তনে প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। চারদিকে শেষ সীমানা গুলি ছিল নিম্নরূপ:
সিন্ধু সভ্যতার চারিদিকের শেষ সীমানাঃ
| শেষ সীমা |
কেন্দ্র |
অবস্থান |
| পূর্বতম |
আলমগীরপুর |
উত্তর প্রদেশ, ভারত |
| পশ্চিমতম |
সুতকাজেন-ডোর |
বেলুচিস্তান, পাকিস্তান, মাকরান উপকূল, ইরানের সীমান্তের কাছে |
| উত্তরতম |
শর্টুগাই |
আফগানিস্তান |
| দক্ষিণতম |
দাইমাবাদ |
মহারাষ্ট্র, ভারত, প্রভারা নদীর তীরে |
2. সিন্ধু সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য
ক. সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্য
সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর উন্নত ও সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা।
- পরিকল্পিত নগরী: নগরগুলি সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল:
- উচ্চভূমি বা দুর্গ : নগরের পশ্চিম দিকে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে ছিল। এই অঞ্চলটিকে বলা হয় সিটাডেল। এখানে সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর লোকেরা বসবাস করত। এছাড়া, এখানে প্রাচীর বেষ্টিত প্রশাসনিক ভবন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবন যেমন শস্যাগার, স্নানাগার ইত্যাদি ছিল।
- নিম্নভূমি: পূর্ব দিকে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে ছিল মূল নগর। এখানে সাধারণ মানুষের বসতি ছিল।
- রাস্তাঘাট: রাস্তাগুলি ছিল সরল ও যথেষ্ঠ চওড়া। মুখ্য সড়কগুলি বিস্তৃত ছিল উত্তর থেকে দক্ষিনে। অন্যান্য সড়ক গুলি মুখ্য সড়কগুলিকে সমকোণে ছেদ করতো। আর এভাবেই রাস্তাগুলি নগরকে বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করত।
- আবাস ভবন: রাস্তার দুই ধার দিয়ে আভাস গৃহ ও অন্যান্য বাড়িগুলি অবস্থিত ছিল। বাড়িগুলি পোড়া ইট দিয়ে তৈরি ছিল। বাড়িগুলি সাধারণত সিঁড়িওয়ালা এক বা দুই তলা বিশিষ্ট ছিল। বেশিরভাগ বাড়িগুলিতেই রান্নাঘর ও স্নানঘর মিলিয়ে মোট চার থেকে ছয়টি থাকার ঘর ছিল।
- নিকাশি ব্যবস্থা: উন্নত জল নিকাশি ব্যবস্থা ছিল এই সভ্যতার অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি বাড়ির সামনে ঢাকা জল নিকাশি নালির থাকতো। যেগুলি মূল রাস্তার ড্রেনেজ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ড্রেনগুলি ছিল প্রস্তরখণ্ড দিয়ে ঢাকা এবং তাতে নিয়মিত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল।
খ. সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও নিদর্শন
 |
| প্রতীকী ছবি |
- বৃহৎ স্নানাগার : সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন হলো মহেঞ্জোদারোর বৃহৎ স্নানাগার। এই কাঠামোটি সম্ভবত কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো। এর দুই পাশে ছিল জলে নামার সিঁড়ি। স্নানের পর বেশভূষা পরিবর্তনের জন্য পাশে ছিল ছোটো ছোটো ঘর।
- শস্যাগার : মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পাতে বিশাল শস্যাগারের অস্তিত্ব মিলেছে, যা থেকে বোঝা যায় শস্য মজুত রাখা হতো।
- ডক ইয়ার্ড (বন্দর): গুজরাটের লোথালে একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয় বা ডক ইয়ার্ড পাওয়া গেছে, যা বহির্বাণিজ্যের প্রমাণ বহন করে।
গ. সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি ও জীবিকা
- কৃষি: সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। গম, যব, বার্লি, মটর, তিল, সরিষা ইত্যাদি নানা শস্যের চাষ হতো। বর্ষাকালে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে কৃষি কাজে ব্যবহার করা হতো। সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা প্রথম তুলা চাষ শুরু করে বলে মনে করা হয়। কালিবঙ্গানে কাঠের তৈরি লাঙ্গল ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়।
- পশুপালন: কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালনও ছিল সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি পশু পালন করা হতো। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মালপত্র পরিবহনের জন্য উট ও গাধা পালন করা হতো।
- বাণিজ্য: এই সভ্যতার অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য খুবই উন্নত ছিল। স্থল ও জল উভয় পথেই বাণিজ্য হতো। গুজরাটের লোথাল ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রধান বাণিজ্য বন্দর। এটিকেই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বন্দর বলে মনে করা হয়ে থাকে। তাদের মুখ্য বাণিজ্য পণ্য ছিল তুলা। মেসোপটেমিয়া (সুমের), পারস্য, এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চলত। সিলমোহর ও বাটখারা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় একটি সুসংগঠিত ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা চালু ছিল। বড় বড় বণিক ও তার পরিবারের নিজস্ব সিল ছিল। সেগুলিতে খোদিত ছিল বিভিন্ন সংকেত এবং সংক্ষিপ্ত তথ্য। তবে এগুলিকে সিন্ধুবাসীরা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত কিনা তার যথাযথ কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে সিন্ধু সভ্যতায় দ্রব্য বিনিময় প্রথা প্রচলন ছিল।
ঘ. সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস
- মাতৃদেবীর পূজা: প্রচুর সংখ্যক মাতৃমূর্তি বা মাটির নারীমূর্তি আবিষ্কার হয়েছে, যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সেইসময় মাতৃদেবীর পূজা করা হতো।
- পশুপতি শিব: মহেঞ্জোদারোতে একটি সিলমোহরে তিন-মুখো পুরুষ দেবতার (সম্ভবত আদি-শিব বা পশুপতি মহাদেব) মূর্তি পাওয়া গেছে, যার চারপাশে হাতি, বাঘ, গণ্ডার ও মহিষের মূর্তি খোদিত। তার পায়ের সামনে রয়েছে দুটি হরিণের মূর্তি।
- বৃক্ষ ও পশুর পূজা: অশ্বত্থ গাছ এবং একশৃঙ্গ পশুর পূজা প্রচলিত ছিল।
- প্রতীক পূজা: এছাড়া লিঙ্গ ও যোনী পূজার প্রমাণ মিলেছে।
ঙ. সিন্ধু সভ্যতার শিল্প ও সংস্কৃতি
- সিলমোহর: প্রায় ২০০০টিরও বেশি সিলমোহর পাওয়া গেছে, যা সাধারণত স্টিয়াটাইট পাথর বা পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি। এগুলিতে চিত্রলিপি খোদিত ছিল, তবে তা এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি।
- নৃত্যরত নারীমূর্তি: মহেঞ্জোদাড়ো থেকে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের তৈরি 'নৃত্যরত নারীমূর্তি' এই সভ্যতার উন্নত ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন।
- পোড়ামাটির খেলনা: প্রচুর পরিমাণে মাটির তৈরি মূর্তি, পুতুল, খেলনা ও পাত্র পাওয়া গেছে।
3. সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল
সিন্ধু সভ্যতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হলোঃ
| স্থান |
অবস্থান |
আবিষ্কারক |
| হরপ্পা |
পাঞ্জাব, পাকিস্তান |
দয়ারাম সাহানি |
| মহেঞ্জোদারো |
সিন্ধু, পাকিস্তান |
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় |
| লোথাল |
গুজরাট, ভারত |
এস. আর. রাও |
| কালিবঙ্গান |
রাজস্থান, ভারত |
এ. ঘোষ |
| ধোলাভিরা |
গুজরাট, ভারত |
জে. পি. যোশী |
| রাখিগাড়ি |
হরিয়ানা, ভারত |
অমরেন্দ্র নাথ |
4. লিপির রহস্য
- সিন্ধু লিপি: এই সভ্যতার একটি নিজস্ব চিত্রভিত্তিক লিপি ছিল, যা সিলমোহর এবং মৃৎপাত্রে খোদিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই লিপিটি এখনও পর্যন্ত পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এটি ডানদিক থেকে বামদিকে লেখা হতো বলে মনে করা হয়।
5. সিন্ধু সভ্যতা পতনের কারণ
আনুমানিক ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সিন্ধু সভ্যতার পতন শুরু হয়। পতনের কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতামত গুলি হলো:
- নদীপথের পরিবর্তন: অনেকে মনে করেন সিন্ধু ও তার উপনদী গুলি এবং সরস্বতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা শুকিয়ে যাওয়া এই সভ্যতা বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয় এবং সেইসঙ্গে শহরগুলিতে জলের অভাব দেখা দেয়। ফলে সিন্ধু বাসিরা এই অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হয়।
- বহিরাক্রমণ: স্যার মর্টিমার হুইলারের মতে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ ছিল আর্যদের আক্রমণ। তার মতে মধ্য এশিয়া থেকে আগত আরজোড়া সিন্ধু সভ্যতার শহর গুলিকে একে একে আক্রমণ করতে থাকে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ/বন্যা: প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মহেঞ্জোদারো এবং অন্যান্য শহরে বন্যার ফলে সৃষ্টি এমন পুরু পলির স্তর পাওয়া গেছে। তাই অনেকে মনে করেন, ঘন ঘন বিধ্বংসী বন্যায় সিন্ধু সভ্যতার শহর গুলিকে ধ্বংস করে দেই।
- মহামারী: সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণগুলি আলোচনার ক্ষেত্রে মহামারীর বিষয়টিও কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কোন মারণ রোগ হয়তো মহামারীর আকার ধারণ করে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটায়, যা এই সভ্যতার পতন ডেকে আনে।