ষোড়শ মহাজনপদের ইতিহাস (৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

পরবর্তী বৈদিক যুগে ছোট ছোট জন পদ গুলি যুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত বড় জনপদে পরিণত হয়। 'জনপদ' কথাটির আভিধানিক অর্থ হল সেই স্থান, যেখানে 'জন' বা মানুষ নিজেদের বসতি স্থাপন করে। পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষের দিকে এই জনপদগুলিই ধীরে ধীরে আরও বড় ও শক্তিশালী হয়ে রূপান্তরিত হয় মহাজনপদে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে উত্তর ভারতে এরকম ১৬ টি বৃহৎ রাজ্য গড়ে উঠেছিল, এদের একত্রে বলা হয় 'ষোড়শ মহাজনপদ'।


16-Mahajanapadas-Map-in-bengali
ষোড়শ মহাজনপদের মানচিত্র (আনুমানিক অবস্থান)

ষোড়শ মহাজনপদের নাম ও রাজধানীর তালিকা (এক নজরে)

মহাজনপদ রাজধানী অবস্থান
1. অঙ্গ চম্পা বিহার (মুঙ্গের ও ভাগলপুর)
2. মগধ রাজগৃহ/গিরিব্রজ, পরে পাটলিপুত্র বিহার (পাটনা ও গয়া)
3. কাশী বেনারস/বারাণসী উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর আশেপাশে
4. কোশল শ্রাবন্তী উত্তর প্রদেশ (পূর্ব ভাগ)
5. বৃজি বৈশালী বিহার (বৈশালী, মুজাফফরপুর)
6. মল্ল কুশিনগর ও পাবা উত্তর প্রদেশ (গোরক্ষপুর)
7. চেদি শুক্তিমতী বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল
8. বৎস কৌশাম্বী উত্তর প্রদেশ (এলাহাবাদের কাছে)
9. কুরু ইন্দ্রপ্রস্থ ও হস্তিনাপুর দিল্লি ও মীরাট অঞ্চল
10. পাঞ্চাল অহিচ্ছত্র ও কাম্পিল্য উত্তর প্রদেশ (গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের উচ্চাংশ)
11. মৎস্য বিরাটনগর রাজস্থান (জয়পুর)
12. সূরসেন মথুরা উত্তর প্রদেশ (মথুরা)
13. অস্মক পোটালি বা পোটান গোদাবরী নদীর তীরে (দক্ষিণ ভারত)
14. অবন্তী উজ্জয়িনী ও মহিষ্মতী মধ্য প্রদেশ (মালব অঞ্চল)
15. গান্ধার তক্ষশীলা পাকিস্তান (পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডি)
16. কম্বোজ রাজপুর কাশ্মীর ও আফগানিস্তান

মহাজনপদগুলির উত্থানের কারণ

​১. কৃষির প্রসার ও উৎপাদন বৃদ্ধি: লোহার লাঙ্গলের ব্যবহার এবং উর্বর গাঙ্গেয় সমভূমির কারণে কৃষির অগ্রগতি ঘটে এবং উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যায়। যার ফলে জনপদ গুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে মহাজনপদের ভিত গঠিত হয়।

২. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে। উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য বা শস্য ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে। নতুন নতুন বণিক শ্রেণী ও কারিগর শ্রেণীর উত্থান হয়, যারা রাষ্ট্রকে কর দিতে সক্ষম ছিল। এর ফলে বাণিজ্যের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে নগর কেন্দ্রগুলি জনপদ থেকে মহাজনপদে রূপান্তরিত হয়।

৩. সামরিক শক্তি বৃদ্ধি: সেইসময় সম্পদ এবং উর্বর জমির অধিকার নিয়ে জনপদগুলির মধ্যে সংঘর্ষ অনেক বেড়ে যায়। এই যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য ক্ষুদ্র জনপদগুলি একত্রিত হয়ে বৃহৎ মহাজনপদে পরিণত হয়।

৪. ভৌগোলিক সুবিধা: উর্বর গাঙ্গেয় সমভূমি ছিল কৃষি কাজের জন্য বিশেষ উপযোগী। সেই সঙ্গে এই অঞ্চল ছিল যথেষ্ট লৌহ সমৃদ্ধ যা অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরি সহজ করে তুলেছিল। এছাড়া, কিছু মহাজনপদের বিশেষ সুবিধা ছিল নদী দ্বারা সুরক্ষিত রাজধানী। যেমন মগধের রাজগৃহ ছিল পাঁচটি পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত।


এই সময়ে বেশিরভাগ রাজ্যেই রাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও কিছু মহাজনপদ 'গণ' বা 'সংঘ' নামে পরিচিত প্রজাতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখেছিল (যেমন: বৃজি, মল্ল)।


ষোড়শ মহাজনপদের পরিচিতি

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ 'অঙ্গুত্তর নিকায়' এবং জৈন ধর্মগ্রন্থ 'ভগবতী সূত্র' থেকে এই ষোলোটি রাজ্যের নাম জানা যায়। এগুলি হলো:


1. অঙ্গ:

অঙ্গ মহাজনপদটি ছিল ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে পূর্বতম রাজ্য। বিহারের মুঙ্গের ও ভাগলপুর জেলা এবং পশ্চিম বঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে এই রাজ্যটি গঠিত ছিল। এর রাজধানী ছিল চম্পা। এটি পূর্বে 'মালিনীপুরী' নামে পরিচিত ছিল। অঙ্গ মহাজনপদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মগধ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মগধের প্রথম শক্তিশালী রাজা বিম্বিসার অঙ্গ আক্রমণ করেন এবং রাজা ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত ও হত্যা করে অঙ্গকে মগধ সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করেন।


2. মগধ:

মগধ ছিল ষোড়শ মহাজনপদগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্য। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বৃহদ্রথ ও তার পুত্র জরাসন্ধ। বর্তমান বিহারের পাটনা ও গয়া জেলা এবং পশ্চিম বঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে এই রাজ্যটি গঠিত ছিল। এর রাজধানী ছিল রাজগৃহ বা গিরিব্রজ। এটি পাঁচটি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল।  যা একে প্রাকৃতিক দুর্গের ন্যায় সুরক্ষা প্রদান করত। মগধের পরবর্তী রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। গঙ্গা, শোণ ও গণ্ডক নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হওয়ায় পাটলিপুত্র ছিল প্রায় এক 'জলদুর্গ'।  অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থান এবং লোহার প্রাচুর্য থাকায় মগধ সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অন্য মহাজনপদগুলির থেকে অনেক এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে মগধ বাকি মহাজনপদগুলিকে দখল করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। (যেমন হর্ষঙ্ক, শিশুনাগ, নন্দ ও মৌর্য বংশ)।


3. কাশী:

কাশী মহাজনপদটি অবস্থিত ছিল উত্তরপ্রদেশের বারাণসী অঞ্চলজুড়ে। এর রাজধানী ছিল বেনারস, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। কাশী রাজ্যের উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। প্রথম দিকে কাশি ছিল একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাজ্য। তবে পরবর্তীতে কোশল, অঙ্গ ও মগৎ রাজ্যের সাথে সংঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষে কোশল রাজ্যের রাজা প্রসেনজিৎ কাশি রাজ্য জয় করেন।


4. কোশল:

কোশল মহাজনপদটি অবস্থিত ছিল উত্তরপ্রদেশ ও নেপালের দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে। এর রাজধানী ছিল শ্রাবন্তী। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল সাকেত(অযোধ্যা)। প্রাচীন ভারতে কোশল মোহাজনপদটি ছিল অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী রাজ্য। কোশল রাজ্যের সবথেকে জনপ্রিয় শাসক ছিলেন প্রসেনজিৎ। প্রসেনজিতের বোনের সঙ্গে মগধের রাজা বিম্বিসারের বিবাহ হয়েছিল। সেই সময় মগধের সঙ্গে কৌশল রাজ্যের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে পরবর্তীতে অজাতশত্রু মগধের সিংহাসনে বসার পর কোশল রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। এবং পরে প্রসেনজিতের মৃত্যুর পর কোশল রাজ্য মগধের অংশে পরিণত হয়।


5. বজ্জি বা বৃজি:

এটি মগধের ঠিক উত্তরে, গঙ্গা নদীর অপর পারে অর্থাৎ, বর্তমান উত্তর বিহারের মিথিলা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এর রাজধানী ছিল বৈশালী। এটি ছিল একটি গণ-সংঘ বা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। এটি একটি রাজা দ্বারা শাসিত না হয়ে, প্রধান গোষ্ঠীর বয়সজ্যেষ্ঠ ও অভিজাত সদস্যদের দ্বারা গঠিত একটি পরিষদ বা সাধারণ সভা দ্বারা পরিচালিত হতো। ২৪তম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর এই সংঘের অন্তর্গত জ্ঞাত্রিক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। বৃজি সংঘের স্বাধীনতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক রাজ্যে মগধ ছিল তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। শেষে অজাতশত্রু বৃজি সংঘকে পরাজিত করে মগধ সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করেন।


6. মল্ল:

বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার  মল্ল রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এর অবস্থান ছিল বজ্জি এবং কোশল রাজ্যের মাঝে। মল্ল মহাজনপদের দুটি রাজধানী ছিল কুশীনগর পাভা।বজ্জি রাজ্যের মতোই এটি ছিল একটি গণ-সংঘ বা প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য। এই রাজ্যটি ধর্মীয় কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। কারণ এটিই ছিল সেই স্থান যেখানে মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ উভয়েই তাঁদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধের মৃত্যুর পরপরই মল্লদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত দেখা দেয়। পাবা এবং কুশীনগরের মল্লরা বুদ্ধের দেহাবশেষ সৎকার নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মগধের রাজা মল্ল রাজ্য জয় করে নেয় এবং এটিকে মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে।


7. চেদি:

চেদি মহাজনপদটি মধ্য ভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের আশেপাশে এবং যমুনা নদীর দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।​ এটি ছিল একটি রাজতান্ত্রিক রাজ্য এবং এখানে বংশানুক্রমিক রাজারা  শাসন করতেন। এর রাজধানী ছিল শুক্তিমতী। চেদি রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক ছিলেন শিশুপাল। পরবর্তীকালে চেদি রাজ্য সম্ভবত অবন্তী বা মগধ সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যায়।


8. বৎস:

বর্তমান উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের কাছাকাছি অঞ্চলে বৎস রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এই রাজ্যটিতে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এর রাজধানী ছিল কৌশাম্বী। এটি ছিল সেই সময়ের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী এবং দুর্গবেষ্টিত নগরী। বৎস রাজ্যের সবথেকে শক্তিশালী রাজা ছিলেন উদয়ন। উদয়নের মৃত্যুর পর অবন্তীর রাজা প্রদ্যোত্ত বৎস রাজ্য দখল করে নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে।


9. কুরু:

বর্তমান দিল্লি, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মিরাট অঞ্চলের আশেপাশের এলাকা নিয়ে কুরু রাজ্যটি গঠিত ছিল। এই অঞ্চলটি গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের উচ্চ অংশ। এর রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। এছাড়া অপর একটি রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর। এটি ছিল মূলত একটি রাজতান্ত্রিক রাজ্য। বৈদিক যুগে এটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। এই কুরু রাজ্যটি ছিল মহাভারত মহাকাব্যের প্রধান উল্লেখিত রাজ্য। কুরুক্ষেত্রের সমভূমি এই কুরু রাজ্যের অংশ ছিল, যা মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে, একটি বন্যার কারণে হস্তিনাপুর ক্ষতিগ্রস্ত হলে কুরু রাজবংশের একটি শাখা দক্ষিণে চলে যায়। তবে অনেকের মতে, শেষের দিকে কুরু রাজ্য সম্ভবত পাঞ্চাল বা মগধ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে যায়।


10. পাঞ্চাল:

বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের উচ্চাংশে পাঞ্চাল রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এর একটি রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র এবং উপর একটি রাজধানী ছিল কাম্পিল্য।প্রাথমিকভাবে এটি ছিল একটি রাজতান্ত্রিক রাজ্য। তবে পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়। এই রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন দ্রুপদ। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শক্তিশালী নন্দ সাম্রাজ্যের রাজা মহাপদ্ম নন্দের রাজত্বকালে পাঞ্চাল রাজ্যটি মগধ সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।


11. মৎস:

মৎস রাজ্যটি বর্তমান রাজস্থানের জয়পুর, আলওয়ার এবং ভরতপুর অঞ্চলের আশেপাশে অবস্থিত ছিল। এর রাজধানী ছিল বিরাটনগরী। এটিতে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই রাজ্যের সবথেকে উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন রাজা বিরাট। মহাভারত অনুসারে, পাণ্ডবরা তাঁদের এক বছরের অজ্ঞাতবাস মৎস্য রাজ্যে রাজা বিরাটের দরবারে কাটিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এটি অবন্তী ও মগধ রাজ্যের অধীনে চলে যায়।


12. সূরসেন:

সূরসেন মহাজনপদটি অবস্থিত ছিল যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে, বর্তমান উত্তর প্রদেশের মথুরা অঞ্চল জুড়ে। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল মথুরা। এই রাজ্যে যাদব বা যদু বংশের শাসন ছিল। এই বংশেই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সূরসেন রাজ্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন উগ্রসেন। পরে তার পুত্র কংস রাজ্য দখল করেন। তিনি অত্যাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণ কংসকে পরাজিত করে রাজ্য দখল করেন। এই রাজ্যে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে সূরসেন রাজ্য মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।


13. অস্মক বা অষ্মক:

ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের একমাত্র মহাজনপদ ছিল অস্মক। ​এটি গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। বর্তমান তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে এটি গঠিত ছিল। বিন্ধ্য পর্বতমালার দক্ষিণে অবস্থিত হওয়ায় এটিকে দক্ষিণাপথের রাজ্য বলা হয়। এর রাজধানী ছিল পোটালি বা পোটান। অস্মকের শাসন ব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। অনেকের মতে, শেষে এই রাজ্যটি অবন্তি রাজ্যের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।


14. অবন্তী:

অবন্তী রাজ্যটি মূলত বর্তমান মধ্যপ্রদেশের মালব অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। এছাড়া অপর একটি রাজধানী ছিল মহিষ্মতী। অবন্তী রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক ছিলেন রাজা প্রদ্যোত বা চণ্ড প্রদ্যোত। পরবর্তীকালে শিশুনাগ অবন্তীর রাজা নন্দীবর্ধনকে পরাজিত করে অবন্তীকে মগধ সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করেন।


15. গান্ধার:

গান্ধার মহাজনপদটি ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। বর্তমানের উত্তর পাকিস্তান (পেশোয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি জেলা) এবং পূর্ব আফগানিস্তানের কিছু অংশ এই রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা। এই রাজ্যের গান্ধার শিল্পকলা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। গান্ধার রাজ্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন পুরুষ। পরবর্তীকালে এটি পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়।


16. কম্বোজ:

এটি ছিল গান্ধার মহাজনপদের প্রতিবেশী রাজ্যে। কম্বোজ রাজ্যটি বর্তমানের আফগানিস্তান (হিন্দু কুশ পর্বতমালা) এবং উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের (কাশ্মীরের রাজৌরি ও হাজারা জেলা) কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এর রাজধানী ছিল রাজপুর। কম্বোজের অধিবাসীরা তাদের উন্নত প্রজাতির অশ্ব এবং রণকৌশলের জন্য সুপরিচিত ছিল। অনেকের মতে, কম্বোজে শুরুতে রাজতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও পরবর্তীকালে এখানে প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হয়।


ষোড়শ মহাজনপদের ​রাজনৈতিক কাঠামো

​মহাজনপদগুলিতে প্রধানত দুই ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল:

​১. রাজতন্ত্র: অধিকাংশ মহাজনপদেই রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এখানে রাজা ছিলেন রাজ্যের সর্বময় কর্তা এবং রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক।

২. প্রজাতন্ত্র বা 'গণ'/'সঙ্ঘ': বজ্জি ও মল্ল রাজ্য দুটিতে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজ্যের প্রধান একটি পরিষদ বা সভার সাহায্যে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তবে একজনের হাতে সম্পূর্ণ শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল না।  


মগধের উত্থান ও মহাজনপদের পরিসমাপ্তি:

ষোড়শ মহাজনপদগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। শেষ পর্যন্ত, প্রাকৃতিক সম্পদ, লৌহ খনি থেকে অস্ত্রের যোগান, উর্বর জমি এবং শক্তিশালী শাসকদের (যেমন: বিম্বিসার, অজাতশত্রু) কারণে মগধ বাকি মহাজনপদগুলির উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। মগধ ধীরে ধীরে অঙ্গ, কাশী, কোশল ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। মগধের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধ। তবে মগধের উত্থান শুরু হয় হর্যঙ্ক বংশের শাসনকাল থেকে। শিশুনাগ ও নন্দ বংশের সময়ে এই সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। এবং সাম্রাজ্য শীর্ষে পৌঁছেছিল মৌর্যদের শাসনকালে।

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post