বৌদ্ধ ধর্ম হল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী ধর্মগুলোর মধ্যে একটি। এটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে (600 খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রাচীন ভারতে উদ্ভূত হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হলেন গৌতম বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
আদি পর্ব: গৌতম বুদ্ধ
জন্ম ও শৈশব:
বেশিরভাগ ঐতিহাসিকদের মতে, গৌতম বুদ্ধ আনুমানিক 563 খ্রিস্টপূর্বাব্দে বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর লুম্বিনীতে শাক্য বংশের রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন রাজা শুদ্ধোধন। এবং মাতা ছিলেন মহামায়া। গৌতম বুদ্ধের পৃত্রিদত্ত নাম ছিল সিদ্ধার্থ। তার জন্মের 7 দিন পর তার মাতা মারা যায়। তাই বিমাতা গৌতমী তাকে লালন-পালন করেন।
চতুর দৃশ্য:
রাজপ্রাসাদের বিলাসী জীবনে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও, 29 বছর বয়সে তিনি চারজন মানুষের দুঃখজনক দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখেন। চারজনের মধ্যে একজন বৃদ্ধ মানুষ, একজন পীড়িত মানুষ, একজন মৃত মানুষ এবং একজন সন্ন্যাসী। এই দৃশ্যগুলো তাকে জাগতিক দুঃখের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে অনুপ্রাণিত করে।
মহাভিনিষ্ক্রমণ:
29 বছর বয়সে তিনি তার স্ত্রী, পুত্র ও রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন, যা 'মহাভিনিষ্ক্রমণ' নামে পরিচিত।
বোধিলাভ:
দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর তপস্যার পর, অবশেষে 35 বছর বয়সে, তিনি বিহারের গয়া (বর্তমান বোধগয়া)-তে একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে 'বোধি' (জ্ঞান) লাভ করেন। এরপর থেকেই তিনি 'বুদ্ধ' নামে পরিচিত হন।
ধর্মচক্র প্রবর্তন:
জ্ঞান লাভের পর, বুদ্ধ উত্তরপ্রদেশের সারনাথের মৃগদাবে তাঁর প্রথম পাঁচজন শিষ্যের কাছে যে উপদেশ দেন, তা 'ধর্মচক্র প্রবর্তন' নামে পরিচিত। তিনি তার শিক্ষা প্রচারের জন্য পরবর্তী 45 বছর ধরে ভারত ভ্রমণ করেন।
চার আর্য সত্য:
বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি হলো চার আর্য সত্য। গৌতম বুদ্ধ জ্ঞান লাভের পর এই চারটি সত্যই প্রথম প্রচার করেন। এগুলি মানুষের দুঃখ এবং তা থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করে। চারটি আর্য সত্য হলো:
- জগৎ দুঃখময়: প্রথম সত্য হলো যে, মানব জীবন দুঃখময়। দুঃখ বলতে শুধু কষ্ট নয়, জীবনের নশ্বরতা, অস্থিরতা এবং অতৃপ্তিকেও বোঝানো হয়েছে। জন্ম, বার্ধক্য, ব্যাধি, মৃত্যু, অপ্রিয় বস্তুর সাথে সংযোগ এবং প্রিয় বস্তুর বিচ্ছেদ এই সবই দুঃখের অন্তর্ভুক্ত।
- দুঃখ সমুদয়: দ্বিতীয় সত্য হলো দুঃখের কারণ। বুদ্ধের মতে, দুঃখের মূল কারণ হলো তৃষ্ণা বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা, লোভ এবং আসক্তি। এই তৃষ্ণাই মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ রাখে।
- দুঃখ নিরোধ: তৃতীয় সত্যটি হলো দুঃখ নিবারণ। যেহেতু দুঃখের কারণ তৃষ্ণা, তাই তৃষ্ণা বা আসক্তিকে সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্তি করা গেলে দুঃখের অবসান সম্ভব। এই অবস্থাই হলো নির্বাণ লাভ বা পরম মুক্তি।
- দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদ: চতুর্থ সত্যটি হলো সেই পথ, যা অনুসরণ করে নির্বাণ লাভ করা যায়। এই পথটি হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা মধ্যপন্থা।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ:
'অষ্টাঙ্গিক মার্গ' বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো বৌদ্ধ ধর্মের চতুর্থ আর্য সত্য অর্থাৎ দুঃখ নিরোধের পথ। গৌতম বুদ্ধ যে আটটি পথকে দুঃখ থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভের মধ্যপন্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেগুলি হলো:
- 1. সৎ দৃষ্টি: চার আর্য সত্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান।
- 2. সৎ সংকল্প: অহিংসা ও ত্যাগের প্রতি দৃঢ় মানসিকতা।
- 3. সৎ বাক্য: মিথ্যা ও রূঢ় কথা পরিহার।
- 4. সৎ কর্ম: হত্যা, চুরি ও অন্যান্য অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা।
- 5. সৎ জীবনধারণ: সৎ ও অহিংস জীবিকা গ্রহণ।
- 6. সৎ প্রচেষ্টা: কল্যাণকর চিন্তা তৈরি ও অকল্যাণকর চিন্তা দূর করার চেষ্টা।
- 7. সৎ স্মৃতি: শরীর ও মনের প্রতি সর্বদা সজাগ থাকা।
- 8. সৎ সমাধি: ধ্যানের মাধ্যমে গভীর মানসিক একাগ্রতা অর্জন।
মহাপরিনির্বাণ:
ধারণা করা হয়, আনুমানিক 483 খ্রিস্টপূর্বাব্দে 80 বছর বয়সে কুশিনগরে গৌতম বুদ্ধ দেহত্যাগ করেন। তার এই দেহত্যাগের ঘটনা 'মহাপরিনির্বাণ' নামে পরিচিত।
শাস্ত্রীয় যুগ ও বৌদ্ধ সংগীতি
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর শিক্ষা সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য চারটি প্রধান সম্মেলন (সংগীতি) অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি:
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয় রাজগৃহে। বুদ্ধের মৃত্যুর পরপরই এটি অনুষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন মহাকশ্যপ। সময়টা ছিল আনুমানিক 483 খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই সময় মগধের রাজা ছিলেন অজাতশত্রু। এই সংগীতিতেই ত্রিপিটকের প্রথম দুই পিটক অর্থাৎ, সূত্র পিটক ও বিনয় পিটক সংকলিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের শিক্ষা (ধর্ম বা সূত্র) এবং ভিক্ষুদের নিয়মাবলী (বিনয়) সংকলন করা।
দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি:
এটি অনুষ্ঠিত হয় বৈশালীতে। আনুমানিক 100 বছর পর এটি অনুষ্ঠিত হয়। সময়টা ছিল আনুমানিক 383 খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এর সভাপতি ছিলেন সবাকামী। মগধের রাজা কালাশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি অনুষ্ঠিত হয়। ভিক্ষুদের মধ্যে নিয়মাবলী সংক্রান্ত মতপার্থক্য মেটানো ছিল এর উদ্দেশ্য।
তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি:
এটি অনুষ্ঠিত হয় পাটলিপুত্রে। সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় আনুমানিক 250 খ্রিস্টপূর্বাব্দে অনুষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন মোগ্গলীপুত্র তিষ্য। এই সময় ত্রিপিটক চূড়ান্তভাবে সংকলিত হয়, যার মধ্যে অভিধর্ম পিটক যুক্ত হয়।
চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি:
এটি অনুষ্ঠিত হয় কুন্দলবন বা কাশ্মীরে। আনুমানিক 72 খ্রিস্টাব্দে কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের রাজত্বকালে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন বসুমিত্র। এই সময়ে বৌদ্ধ পন্ডিতদের মধ্যে বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়। বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়।
বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বায়ন
বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল সম্রাট অশোকের (268-232 খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজত্বকাল।
- অশোকের পৃষ্ঠপোষকতা: কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অনুশোচনা থেকে অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি এটিকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেন। তিনি শিলালিপি ও স্তূপ নির্মাণের মাধ্যমে ধর্মের প্রচার করেন।
- মিশনারি কার্যকলাপ: অশোক তাঁর পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে শ্রীলঙ্কা-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠান। ফলে এই ধর্ম ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করে।
বৌদ্ধ ধর্মের বিভাজন
গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের প্রায় 250 বছরের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রধানত হীনযান ও মহাযান নামে দুটি বড় শাখায় বিভক্ত হয়।
হীনযান:
হীনযান" শব্দের অর্থ হলো 'ক্ষুদ্র যান' বা 'ছোট পথ'। এটি শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়াতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মূল বৈশিষ্ট্য গুলি হল:
- শিক্ষার উৎস: এর অনুসারীরা বুদ্ধের মূল শিক্ষা বা ত্রিপিটকের পালি সংস্করণের প্রতি সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত ছিলেন।
- আদর্শ: হীনযানের সর্বোচ্চ আদর্শ হলো অর্হৎ হওয়া। অর্হৎ হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ব্যক্তিগতভাবে বুদ্ধের নির্দেশিত পথে সাধনা করে নির্বাণ লাভ করেন এবং সকল দুঃখের অবসান ঘটান।
- নির্বাণের পথ: নির্বাণ লাভ বা মুক্তি এখানে মূলত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফল। প্রত্যেককে নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করতে হয়।
- বুদ্ধের ধারণা: বুদ্ধকে এখানে একজন ঐতিহাসিক শিক্ষক এবং পথ-প্রদর্শক হিসেবে দেখা হয়। যিনি সাধারণ মানুষের মতো জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কঠোর সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। এটিতে বুদ্ধকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো না। অর্থাৎ এর অনুসারীরা মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী নয়।
- প্রচার ও প্রসার: এটি প্রধানত শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মায়ানমার (বার্মা), কম্বোডিয়া এবং লাওসের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রচলিত হয়।
মহাযান:
'মহাযান' শব্দের অর্থ হলো 'মহৎ যান' বা 'বৃহত্তর পথ'। এটি চীন, জাপান, কোরিয়া এবং তিব্বতে ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল বৈশিষ্ট্য গুলি হল:
- শিক্ষার উৎস: মহাযানের অনুসারীরা ত্রিপিটক ছাড়াও তাদের নিজস্ব সূত্র বা শাস্ত্র (যেমন প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র) অনুসরণ করে। তারা মনে করে বুদ্ধের উচ্চতর ও গভীর শিক্ষা এই সূত্রগুলোতে নিহিত।
- আদর্শ: মহাযানের সর্বোচ্চ আদর্শ হলো বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্ব হলেন সেই ব্যক্তি যিনি নির্বাণ লাভ করার পরও, জগতের সকল প্রাণীর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বেচ্ছায় নিজের নির্বাণ স্থগিত রাখেন এবং অন্যদের সাহায্য করেন।
- নির্বাণের পথ: মহাযান অনুসারে মুক্তি ব্যক্তিগত নয়, বরং সামগ্রিক। অন্যের প্রতি করুণা দেখিয়ে এবং তাদের মুক্তির জন্য কাজ করার মাধ্যমেই প্রকৃত মুক্তি আসে। এর অনুসারীরা বুদ্ধদেবের মুক্তি গড়ে পূজা করাই বিশ্বাসী।
- বুদ্ধের ধারণা: বুদ্ধকে এখানে একজন অতিমানবীয় এবং চিরন্তন সত্তা হিসেবে দেখা হয়। তাদের কাছে অনেক বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্ব আছেন, যারা সাধকদের মুক্তি পেতে সাহায্য করেন।
- প্রচার ও প্রসার: এটি প্রধানত চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তিব্বত এবং মঙ্গোলিয়ার মতো পূর্ব এশিয়া ও হিমালয় অঞ্চলে প্রচলিত।
বৌদ্ধ সাহিত্য
বৌদ্ধ সাহিত্যকে প্রাথমিকভাবে দুটি প্রধান ধারা এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে ভাগ করা যায়। বৌদ্ধ ধর্মের আদি সাহিত্য সাধারণত পালি এবং পরবর্তী সাহিত্য মূলত সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল।
মূল ধর্মগ্রন্থ: ত্রিপিটক
ত্রিপিটক হলো বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ। 'ত্রিপিটক' শব্দের অর্থ হলো 'তিনটি ঝুড়ি'। এটি মূলত পালি ভাষায় রচিত এবং থেরবাদ (হীনযান) শাখার মূল ভিত্তি।
◉ বিনয় পিটক
- বিষয়বস্তু: এটি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জন্য সংঘের আচরণবিধি, নিয়মাবলী এবং জীবনযাপন সংক্রান্ত নির্দেশিকা নিয়ে গঠিত।
- গুরুত্ব: সংঘের শৃঙ্খলা ও পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য এটি অপরিহার্য।
◉ সুত্ত পিটক
- বিষয়বস্তু: এটি হলো গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর প্রধান শিষ্যদের দ্বারা প্রদত্ত উপদেশ, ধর্মোপদেশ এবং কথোপকথনগুলির সংগ্রহ।
- প্রধান ভাগ: এতে পাঁচটি প্রধান বিভাগ বা নিকায় রয়েছে, যেমন দীর্ঘ নিকায়, মজ্ঝিম নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, অঙ্গুত্তর নিকায় এবং খুদ্দক নিকায়।
- গুরুত্ব: এটি বুদ্ধের মূল দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষাগুলির উৎস।
◉ অভিধর্ম পিটক
- বিষয়বস্তু: এটি বুদ্ধের শিক্ষাগুলির দার্শনিক ব্যাখ্যা, মনোবিজ্ঞান এবং উচ্চতর দর্শন নিয়ে গঠিত।
- গুরুত্ব: এটি ধর্মীয় সত্যের বৈজ্ঞানিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে। এটি প্রধানত তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে সংকলিত হয়েছে।
মহাযান সূত্র
মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের নিজস্ব বিপুল সাহিত্য ভান্ডার রয়েছে, যা প্রধানত সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং পরে চীনা, তিব্বতি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদিত হয়।
- প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র: 'প্রজ্ঞার পূর্ণতা' নামে পরিচিত এই সূত্রগুলি শূন্যতা এবং বোধিসত্ত্বের আদর্শের উপর জোর দিয়েছে। এর মধ্যে বিখ্যাত হল হৃদয় সূত্র এবং হীরক সূত্র।
- সদ্ধর্ম পুণ্ডরীক সূত্র বা লোটাস সূত্র: এটি মহাযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। এটি বুদ্ধের চিরন্তন প্রকৃতি এবং সকল প্রাণীর বুদ্ধত্ব লাভের সম্ভাবনার কথা বলে।
- অবতংসক সূত্র বা ফ্লাওয়ার গার্ল্যান্ড সূত্র: এটি মহাবিশ্বের আন্তঃসংযুক্ততা এবং ঐক্যের ধারণা বর্ণনা করে।
- দশভূমিক সূত্র: এটি বোধিসত্ত্বের দশটি স্তর বা ধাপ গুলিকে বর্ণনা করে।
ভাষ্য সাহিত্য
ত্রিপিটক এবং সূত্রগুলির গভীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার জন্য বহুভাষ্য এবং গ্রন্থ রচিত হয়েছিল:
- মিলিন্দ পঞহো: এটি থেরবাদ ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি ইন্দো-গ্রিক রাজা মেনান্ডার (মিলিন্দ) এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের মধ্যে হওয়া দার্শনিক কথোপকথনের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধারণা ব্যাখ্যা করে।
- বিসু্দ্ধিমাগ্গা: আচার্য বুদ্ধঘোষ কর্তৃক রচিত এই গ্রন্থটি থেরবাদ ঐতিহ্যে মুক্তি লাভের পথ এবং ধ্যানের পদ্ধতিগুলির একটি বিশদ ম্যানুয়াল।
- বিভাষা শাস্ত্র: কণিষ্কের চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতিতে ত্রিপিটকের ওপর যে টীকা সংকলিত হয়েছিল।
জাতক এবং অন্যান্য আখ্যানমূলক সাহিত্য
- জাতক: খুদ্দক নিকায়ের একটি অংশ। এটি মূলত গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্মগুলির ৫৪৭টি গল্প নিয়ে গঠিত, যা নৈতিকতা, করুণা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়। এই গল্পগুলো ভারতের ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
- ললিতবিস্তর: বুদ্ধের জীবনী বর্ণনা করে, যা মহাযান ঐতিহ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিব্বতীয় ও বজ্রযান সাহিত্য
বজ্রযান শাখার নিজস্ব বিশাল সাহিত্য রয়েছে, যা 'কঞ্জুর' (বুদ্ধের কথা) এবং 'তেঞ্জুর' (টীকা ও ভাষ্য) নামে দুটি প্রধান অংশে সংকলিত।
- তন্ত্র: এটি বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের মূল গ্রন্থ। বিভিন্ন যোগিক অনুশীলন, আচার-অনুষ্ঠান এবং দেব-দেবীর আরাধনা নিয়ে এটি গঠিত।
ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণ
গুপ্ত যুগ (খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতক) পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই সময় নালন্দা ও বিক্রমশীলার মতো বৃহৎ মহাবিহারগুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। একসময় অত্যন্ত প্রভাবশালী ও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করা সত্বেও বৌদ্ধ ধর্ম তার জন্মভূমিতেই খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এই বিলুপ্তির পিছনে একাধিক কারণ ছিল। কারণ গুলি হলো নিম্নরূপ:
বিলাসিতা ও নিষ্ক্রিয়তা:
গুপ্ত যুগের পর, নালন্দা ও বিক্রমশীলার মতো বৃহৎ মহাবিহারগুলো বিপুল পরিমাণে রাজকীয় ও বণিকদের দান পেতে শুরু করে। ফলে এই বিহারগুলো ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেখানে শিক্ষাদান ও আধ্যাত্মিক সাধনার চেয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন প্রাধান্য পেতে শুরু করে।
তাৎপর্য হারানো:
বৌদ্ধধর্মের প্রধান আকর্ষণ ছিল এর সরলতা এবং জাতিভেদহীনতা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বৌদ্ধধর্মেও জটিল আচার-অনুষ্ঠান, তান্ত্রিক প্রভাব এবং মূর্তি পূজা বৃদ্ধি পায়। ফলে এটি সনাতন ধর্মের মতোই জটিল হয়ে ওঠে এবং এর মৌলিক আবেদন হারায়।
বজ্রযানের উত্থান:
মহাযানের তান্ত্রিক রূপ, বজ্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান হয়। এই তান্ত্রিক চর্চাগুলিতে অনেক সময় গোপনীয় ও বিতর্কিত আচারের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি করে।
শঙ্করাচার্যের প্রভাব:
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে আদি শঙ্কর (শঙ্করাচার্য) অদ্বৈত বেদান্তের প্রচারের মাধ্যমে সনাতন ধর্মকে দার্শনিক স্তরে সুসংগঠিত করেন। তিনি বৌদ্ধদের শূন্যবাদকে বুদ্ধির জোরে খণ্ডন করেন এবং সনাতন ধর্মের প্রতি বিদ্বানদের আকর্ষণ ফিরিয়ে আনতে সফল হন।
ভক্তি আন্দোলনের উত্থান:
মধ্যযুগে যে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়, তা সাধারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরকে পাওয়ার সহজ ও আবেগপূর্ণ পথ খুলে দেয়। এর ফলে জটিল দর্শন ও আচার-সর্বস্ব বৌদ্ধ ধর্মের প্রয়োজন কমে যায়।
গুপ্তদের পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস:
গুপ্ত সাম্রাজ্যের অনেক শাসক বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও, তারা প্রধানত সনাতন ধর্মের সমর্থক ছিলেন। পরবর্তী রাজবংশগুলিও বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ও মন্দির নির্মাণে বেশি মনোযোগী হয়। এর ফলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য কমতে থাকে।
তুর্কি আক্রমণ:
খ্রিস্টীয় একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে মুহাম্মদ ঘোরি এবং তাঁর সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি একাধিকবার ভারতে আক্রমণ করে। বখতিয়ার খিলজি আনুমানিক ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিহারে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারের মতো বৃহৎ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন।
বিশ্বজুড়ে বিস্তার
ভারতে বিলুপ্ত হলেও বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বজুড়ে তার অস্তিত্ব বজায় রাখে এবং বিকশিত হতে থাকে।
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: শ্রীলঙ্কা থেকে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়াতে শক্তিশালী ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
- পূর্ব এশিয়া: মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম সিল্ক রুট ধরে চীন, কোরিয়া এবং জাপানে প্রবেশ করে। জাপানে এটি 'জেন বৌদ্ধ ধর্ম' হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে।
- তিব্বত ও হিমালয়: সপ্তম শতকে তিব্বতে বজ্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ ঘটে। দালাই লামা হলেন এই ঐতিহ্যের প্রধান ধর্মগুরু।
