ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বৈদিক যুগ হলো এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর মূলত বেদকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতা। বৈদিক সভ্যতার স্রষ্টারা আর্য নামে পরিচিত।
আর্যদের পরিচয় ও আগমন
আর্য শব্দের অর্থ: সংস্কৃতে 'আর্য' শব্দের অর্থ হলো সৎ বংশজাত ব্যক্তি বা শ্রেষ্ঠ বংশোদ্ভুত জাতি। তবে বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতে, আর্য কোনো জাতিগত পরিচয় নয় বরং এটি একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম।
আর্যদের আদি বাসস্থান: আর্যদের আদি বাসস্থান নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। ম্যাক্স মুলারের মতে, আর্যরা সম্ভবত মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল। পরবর্তীতেও বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ম্যাক্স মুলারের এই মতবাদকে সমর্থন করেন।
আর্যদের ভারতে আগমনের সময়কাল: অনুমান করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে আর্যদের আগমন শুরু হয়। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ নাগাদ তারা সিন্ধু উপত্যকার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
আর্যদের প্রাথমিক বসতি: আর্যরা প্রথমে সপ্তসিন্ধু (বর্তমান পাঞ্জাব ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অর্থাৎ, সিন্ধু, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু ও সরস্বতী নদী দ্বারা বেষ্টিত) অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। এই অঞ্চলকে ব্রহ্মাবর্ত বা আর্যাবর্তও বলা হতো।
![]() |
| আর্য ও বৈদিক যুগের জীবনযাত্রা (প্রতীকী ছবি) |
বৈদিক যুগকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: 1. আদি বৈদিক যুগ বা ঋক বৈদিক যুগ (১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), 2. পরবর্তী বৈদিক যুগ (১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।
1. আদি বৈদিক যুগ (১৫০০ - ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
আদি বৈদিক যুগের ইতিহাসের প্রধান উৎস হলো ঋগ্বেদ। এই সময় আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে উত্তর ভারতের সমভূমির বিভিন্ন অঞ্চলের ছড়িয়ে পড়ে।
ক. রাজনৈতিক জীবন:
রাজতন্ত্র: এই যুগে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন রাজা (রাজন)। তিনি সামরিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। জনের সদস্যগণ ও তাদের পশু সম্পদের রক্ষায় তিনি সর্বদা সক্রিয় থাকতেন।
শাসন বিভাগ: সমাজের সর্বনিম্ন স্তর ছিল পরিবার। পরিবারের প্রধানকে বলা হতো 'কুলপা'। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হতো গ্রাম। এই গ্রামের প্রধান কে বলা হতো 'গ্রামানী'। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে আবার গঠিত হতো বিশ। এর প্রধান কে বলা হতো 'বিশপতি'। এবং একাধিক বিশ নিয়ে গঠিত হতো জন বা গোষ্ঠী। আর এর প্রধানকেই বলা হতো 'গোপ' বা রাজা। রাজারা 'সম্রাট', 'একরাট' বা 'বিরাট' উপাধি ধারণ করতেন।
রাজনৈতিক সভা: রাজাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ ছিল:
- সভা: এটি বয়স্ক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হতো।
- সমিতি: এটি ছিল গোষ্ঠীর সকল সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান। এই উপজাতি পরিষদ দ্বারায় রাজা নির্বাচিত হতেন।
পুরোহিত: এছাড়া রাজাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার জন্য একজন পুরোহিত থাকতেন। এই পুরোহিতেরা ধর্মীয় ও যজ্ঞের কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন।
খ. সমাজ জীবন:
পারিবারিক কাঠামো: সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক, যেখানে পিতা বা পরিবারের কর্তা ছিলেন প্রধান। তবে মহিলাদের পদমর্যাদাও পুরুষদের সমান সমান ছিল। নারীরাও সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা পেতেন। তারা শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান এবং জনসভায় অংশগ্রহণ করতে পারত। এই যুগের কয়েকজন বিদুষী নারী ছিলেন ঘোষা, লোপামুদ্রা, অপালা। সতীদাহ প্রথার কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এই যুগে সুশৃঙ্খলাবদ্ধ বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিধবা বিবাহেরও প্রচলন ছিল।
বর্ণ প্রথা: শুরুতে সমাজে জাতিভেদ প্রথা কঠোর ছিল না। সমাজের বিভাজন ছিল গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে। এই সময় সমাজ মূলত আর্য ও অনার্য এই দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। আদি বৈদিক যুগে বর্ণাশ্রম প্রথার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
গ. অর্থনৈতিক জীবন:
পশুপালন: আদি বৈদিক যুগে আর্যদের প্রধান জীবিকা ছিল পশুপালন। গরু ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। গোসম্পদ দখলের উদ্দেশ্যে যুদ্ধও হতো। গোধন (গরুর সম্পদ) দিয়ে ধন-সম্পদ পরিমাপ করা হতো। দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেও সেইসময় গরু ব্যবহৃত হতো। সময় পরিমাপের একক ছিল গোধূলি এবং দূরত্ব পরিমাপের একক ছিল গাভ্যুতি।
কৃষি: আদি বৈদিক যুগে কৃষিকাজেরও প্রচলন ছিল। কৃষি কাজ ছিল মানুষের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পেশা। কর্ষিত জমিকে 'ক্ষেত্র' এবং লাঙলের ফলাকে 'সীতা' বলা হতো।
বাণিজ্য: এই সময় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিল বিনিময় প্রথা। স্থলপতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘোড়া ও বলদে টানা গাড়ি ব্যবহৃত হতো। এবং নদীপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো নৌকা। কৃষিজাত পণ্য, বিভিন্ন পশু এবং কারিগরি শিল্পজাত দ্রব্য বিনিময় চলতো।
ঘ. ধর্মীয় জীবন:
আর্যরা মূলত প্রকৃতির উপাসক ছিল। তারা প্রাকৃতিক শক্তিকে দেব-দেবী রূপে পূজা করত।
প্রধান দেব-দেবী:
- ইন্দ্র: শ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন ইন্দ্র। তিনি ছিলেন বৃষ্টি ও বজ্রের দেবতা। তিনি যুদ্ধের দেবতা পুরন্দর নামেও পরিচিত ছিলেন। ঋগ্বেদে ২৫০টি স্তোত্র তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়েছে।
- অগ্নি: দ্বিতীয় প্রধান দেবতা ছিলেন অগ্নি। তিনি মানুষ ও দেবতার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী রূপেও পরিচিত ছিলেন। ২০০টি স্তোত্র তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়েছে।
- বরুণ: জল ও বিশ্ব-বিধানের রক্ষক ছিলেন বরুন।
- সোম: উদ্ভিদের ও দেবতাদের রাজা ছিলেন সোম।
- ধর্মীয় আচরন: মূলত যজ্ঞ ও মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে দেব-দেবীর আরাধনা করা হতো।
2. পরবর্তী বৈদিক যুগ (১০০০ - ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
পরবর্তী বৈদিক যুগের ইতিহাস জানা যায় মূলত সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ থেকে।
ক. রাজনৈতিক জীবন:
বিস্তার: পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যরা সপ্তসিন্ধু অঞ্চল ছাড়িয়ে পূর্ব দিকে গঙ্গা ও যমুনার দোয়াব অঞ্চল এবং পরে দাক্ষিণাত্যের দিকে বসতি বিস্তার করে।
রাজ্যের আকার বৃদ্ধি: এই সময় ছোট ছোট 'জন' বা গোষ্ঠীগুলি একত্রিত হয়ে বড় জনপদ বা মহা জনপদে পরিণত হতে শুরু করে। কুরু, পাঞ্চাল, মগধ ইত্যাদি রাজ্যের উত্থান ঘটে। আর এই জনপদগুলির মধ্যে সীমানা নিয়ে ঘন ঘন যুদ্ধও সংঘটিত হত।
রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি: এই যুগে রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। রাজারা 'একরাট', 'সম্রাট' ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেন। রাজারা সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করে এবং 'রাজসূয়', 'অশ্বমেধ', 'বাজপেয়'-এর মতো বিশাল যজ্ঞের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করতেন।
পরামর্শ সভা: পরবর্তী বৈদিক যুগে সভা ও সমিতির গুরুত্ব কমতে থাকে এবং রাজকর্মচারীর সংখ্যা বাড়ে।
খ. সমাজ জীবন:
বর্ণাশ্রম প্রথা: এই যুগে বর্ণ প্রথা জন্মভিত্তিক ও কঠোর হয়ে ওঠে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষসূক্তে প্রথম বর্ণাশ্রম প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময় সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নামক চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে যায়। ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা ও প্রাধান্য অনেক বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণদের প্রধান কাজ ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন করা, বেদাধ্যয়ন করা এবং শিক্ষাদান করা। এঁরা সমাজে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন এবং কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পেতেন। ব্রাহ্মণদের পরবর্তী স্থানে ছিলেন ক্ষত্রিয়রা। তারাও সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। ক্ষত্রিয়দের প্রধান কাজ ছিল শাসন ও প্রতিরক্ষা কার্য পরিচালনা করা। এরপর সমাজের তৃতীয় স্থানে ছিলেন বৈশরা। বৈশদের প্রধান কাজ ছিল কৃষিকাজ, পশুপালন, এবং ব্যবসা-বাণিজ্য। এরপর সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে ছিলেন শূদ্ররা। শূদ্রদের প্রধান কাজ ছিল সমাজের প্রথম তিন বর্ণের সেবা করা। শূদ্ররা উপনয়ন অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং তাদের বেদ পাঠ বা বেদ শ্রবণের অধিকার ছিল না।
চতুরাশ্রম প্রথা: বৈদিক যুগে আর্যদের জীবনকে চারটি স্তরে ভাগ করা হতো যথা: ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস।
- ব্রহ্মচর্য: সম্ভবত, ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাদেরকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হতো। এটি ছিল জীবনের প্রস্তুতি পর্যায়। এই সময় তাদেরকে গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভ ও নিয়মিত বেদ অধ্যায়ন করতে হতো।
- গার্হস্থ্য: ব্রহ্মচর্যের পর সম্ভবত ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত তাদেরকে গার্হস্থ্য জীবন পালন করতে হতো। এটি ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আশ্রম। এই পর্যায়ে তাদেরকে পরিবার ও সমাজের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব (পঞ্চমহাযজ্ঞ) ও কর্তব্য পালন করতে হতো।
- বানপ্রস্থ: সম্ভবত, ৫০ থেকে ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাদেরকে বানপ্রস্থ জীবন পালন করতে হতো। এই সময়ে তারা সাংসারিক দায়িত্ব থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতো। তারপর সন্তানদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা বনে বা তীর্থস্থানে গমন করতো। এবং আধ্যাত্মিক সাধনা ও তপস্যার প্রতি মনোনিবেশ করতো।
- সন্ন্যাস: সম্ভবত, ৭৫ বছর বয়স থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সময়কালটা তাদের কাটতো সন্ন্যাস আশ্রমে। এই সময়ে তারা সমস্ত জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করতো। এই পর্যায়ে তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মোক্ষ লাভ অর্থাৎ, পরমাত্মার সঙ্গে মিলন। এই সময় তাদেরকে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনধারণ করতে হতো।
নারীর স্থান: পরবর্তী বৈদিক যুগে সমাজে নারীর মর্যাদা হ্রাস পায়। তাদের স্বাধীনতা কমতে থাকে এবং জনসভায় অংশগ্রহণের অধিকার লুপ্ত হয়। শিক্ষা অর্জন করা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। বাল্য বিবাহ বেড়ে যায়। তবে এই যুগেও সতীদাহ প্রথার কোন অস্তিত্ব মেলে না।
গ. অর্থনৈতিক জীবন:
কৃষির প্রাধান্য: এই যুগে পশুপালনের চেয়ে কৃষি প্রধান জীবিকা হয়ে ওঠে। লাঙলে লোহার ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে কৃষি ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তী বৈদিক যুগে গম কে বলা হত গোধূমা এবং চালকে বলা হতো বৃহি।
বাণিজ্যের বিকাশ: পরবর্তী বৈদিক যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরো প্রসার ঘটে। বৈশ্যরা ছিল প্রধান ব্যবসায়ী শ্রেণী। এই যুগে 'মনা' ও 'নিষ্কো'নামে দুটি মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। কুমোর, কামার, তাঁতি ইত্যাদি পেশাগত গোষ্ঠীর উত্থান হয়।
ঘ. ধর্ম ও দর্শন:
ধর্মীয় পরিবর্তন: এই যুগে ঋক বৈদিক যুগের দেব-দেবীর গুরুত্ব কমে যায়। ইন্দ্র ও অগ্নির পরিবর্তে প্রজাপতি (স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা), বিষ্ণু (সংরক্ষক বা রক্ষাকারী) ও রুদ্র-শিব (ধ্বংসকারী) প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন। মূর্তি পূজার প্রচলন হয়। বলিদানের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। ধর্মীয় আচারে আড়ম্বরপূর্ণ যজ্ঞের গুরুত্ব বাড়ে। পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য চরম সীমায় পৌঁছায়। উপনিষদগুলিতে যজ্ঞ ও আড়ম্বরের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ও দর্শনের ওপর জোর দেওয়া হয়। এগুলি থেকেই পরবর্তীতে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মতো প্রতিবাদী ধর্মমতের জন্ম হয়।
বৈদিক সাহিত্য:
বেদ:
বৈদিক সাহিত্যের মূল ভিত্তি ছিল বেদ। 'বেদ' শব্দটি সংস্কৃত 'বিদ্' ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হল 'জানা' বা 'জ্ঞান'। বেদ প্রথমে লিপিবদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। বেদের শ্লোক গুলি সেই সময় শুনে শুনে মনে রাখতে হতো, তাই বেদের অপর নাম হয় শ্রুতি। বিশ্বাস করা হতো বেদের শ্লোকগুলি মনুষ্য রচিত নয় বরং ঈশ্বরের প্রদত্ত। এই কারণে বেদের আর একটি নাম হয় অপৌরুষেয় অর্থাৎ যা মানুষের দ্বারা রচিত নয়। মোট চারটি বেদ ছিল যথা- ঋক, সাম, যর্জু ও অথর্ব। নিচে এই চারটি বেদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
- ঋক্ বেদ: এটি হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় রচিত পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ। এটিতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি দেবতা অর্থাৎ অগ্নি ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, সূর্য এবং অন্যান্য দেবতাগণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত শ্লোক রয়েছে। এতে মোট ১০২৮টি শ্লোক বা স্তোত্র এবং ১০,৪৬২টি মন্ত্র রয়েছে যা দশটি মণ্ডল বা ভাগে বিভক্ত। দশম মন্ডলের পুরুষ সূক্তে প্রথম বর্ণাশ্রম প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়। সূর্য-দেবী সাবিত্রীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গায়ত্রী মন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে তৃতীয় মন্ডলে। ঋক্ বেদের উপবেদ হলো আয়ুর্বেদ।
- সাম বেদ: সামবেদ হল গানের সুর সম্পর্কিত শ্লোক গুলির সংকলন। সামবেদ এর আগের নাম ছিল 'সমন' যার অর্থ হল সুর। আর এর শ্লোকগুলিকে বলা হতো সাম গান। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বা যজ্ঞের সময় পুরোহিতরা এই সাম গানগুলি গেয়ে শোনাতেন। এটিতে মোট ১,৮৭৫টি পদ্ম রয়েছে যেগুলির প্রাথমিক ভাবে ঋক বেদ থেকে সংগৃহীত। এর উপবেদ হলো গান্ধার্ব বেদ।
- যর্জু বেদ: 'যজুঃ' শব্দের অর্থ হল যজ্ঞ বা আরাধনার মন্ত্র। এটি মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং যাগ যজ্ঞের নিয়মাবলী ও মন্ত্রের সংকলন। যর্জু বেদের আদি নাম ছিল যজুমশি। এই বেদ দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত যথা: শুক্ল যজুর্বেদ (এতে কেবল মন্ত্রগুলি রয়েছে) এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ (এতে মন্ত্রগুলির সাথে সেগুলির ব্যাখ্যা বা ব্রাহ্মণ অংশও মিশ্রিত আছে)। এই বেদের উপবেদ হল ধনুর্বেদ।
- অথর্ব বেদ: এই বেদের নাম ঋষি অথর্বণ ও অঙ্গিরার নামানুসারে হয়েছে। এটি বাকি তিনটি বেদের তুলনায় অনেক পরে সংকলিত হয়েছে। বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়া, জাদু-টোনা, রোগ নিরাময়ের মন্ত্র, কালা জাদু ইত্যাদি এটিতে আলোচিত হয়েছে। বিবাহ ও গৃহ নির্মাণের মতো সামাজিক প্রথাগুলির উল্লেখও এটিতে পাওয়া যায়। এই বেদের আদি নাম হলো অথর্বাঙ্গিরশ। অথর্ববেদের উপবেদ হল স্থাপত্য বেদ।
