মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস: উত্থান থেকে পতনের সম্পূর্ণ বর্ণনা

মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্যচন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং তাঁর গুরু চাণক্যের হাতে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর শ্রেষ্ঠত্ব আসে মহান সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে। মৌর্যদের সুসংগঠিত প্রশাসন, বিশাল সামরিক শক্তি এবং শিল্প-স্থাপত্যের বিকাশ ভারতকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিস্টপূর্ব 321 – 297 অব্দ)

mauryan-emperor
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাল্পনিক চিত্র

321 খ্রিস্টপূর্বাব্দে শক্তিশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা ধনানন্দকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের সিংহাসন দখল করেন। এই বিপ্লবে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন কিংবদন্তী রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ চাণক্য বা কৌটিল্য, যিনি 'অর্থশাস্ত্র' রচনা করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুধু একজন প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মহান যোদ্ধা ও সুশাসক। 

​রাজ্য বিস্তার ও বিজয়

​চন্দ্রগুপ্তের হাতে মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে প্রথম প্রকৃত সাম্রাজ্যের রূপ নেয়।
  • মগধ ও মধ্য ভারত: নন্দদের উৎখাত করার পর তিনি মগধের সিংহাসনে বসেন এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলি জয় করে নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
  • উত্তর-পশ্চিম ভারত: আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর উত্তর-পশ্চিম ভারতের গ্রিক শাসনকর্তারা দুর্বল হয়ে পড়লে, চন্দ্রগুপ্ত তাদের পরাজিত করেন। এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু উপত্যকার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করেন।
  • সেলুকাস নিকেটরের সাথে যুদ্ধ: আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি সেলুকাস নিকেটর ভারত আক্রমণের চেষ্টা করলে চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধের ফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধি স্থাপিত হয়। সেলুকাস সিন্ধু নদের পশ্চিমের আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান সহ বিশাল অঞ্চল মৌর্যদের হাতে তুলে দেন। সেলুকাস তাঁর কন্যা হেলেনার সাথে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দেন। আর দূত হিসেবে বিখ্যাত গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসকে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভা পাটলিপুত্রে প্রেরণ করেন। মেগাস্থিনিসের লেখা বিখ্যাত 'ইন্ডিকা' গ্রন্থটি থেকে মৌর্য যুগের ইতিহাস জানা যায়।
  • দক্ষিণ ভারত: জীবনাবসানের আগে চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্যকে দক্ষিণে কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

​শাসন ব্যবস্থা

  • প্রশাসন: চাণক্যের 'অর্থশাস্ত্র'-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত একটি সুসংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা তৈরি করেন। তার রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র।
  • সামরিক শক্তি: তিনি একটি বিশাল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন, যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। ঐতিহাসিকদের মতে, তাঁর সেনাবাহিনীতে 6 লক্ষ পদাতিক সৈন্য, 30 হাজার অশ্বারোহী এবং 9 হাজার হাতি ছিল।

চন্দ্রগুপ্তের ​শেষ জীবন

জীবনের শেষ দিকে চন্দ্রগুপ্ত জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সিংহাসন পুত্র বিন্দুসারের জন্য ছেড়ে দেন। লোককথা অনুসারে, সিংহাসন ত্যাগ করার পর তিনি জৈন গুরু ভদ্রবাহুর সাথে দক্ষিণ ভারতের শ্রবণবেলগোলা চলে যান। সেখানে সল্লেখনা প্রথার মাধ্যমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
​চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন সেই প্রথম ভারতীয় শাসক, যিনি প্রায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে এক ছাতার নিচে এনে প্রথম ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠা করেন।

বিন্দুসার (খ্রিস্টপূর্ব 297 – 273 অব্দ)

​বিন্দুসার ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট। তিনি তাঁর পিতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছ থেকে এক বিশাল সুপ্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। বিন্দু তাঁর রাজত্বকালে  সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিন্দুসারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাধি হলো "অমিত্রঘাত", যার অর্থ হলো "শত্রু বিনাশকারী" বা "শত্রুর হত্যাকারী"।

রাজ্য বিস্তার ও বিদ্রোহ দমন

​বিন্দুসার তাঁর পিতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরে রেখেছিলেন এবং কিছু ছোটখাটো বিস্তারও ঘটিয়েছিলেন।
  • বিজয়: ঐতিহাসিক তারানাথের মতে, বিন্দুসার ষোলোটি রাজ্য জয় করে পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী ভূমি নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
  • ​দক্ষিণ ভারত: চোল, পাণ্ড্য এবং চেরা রাজ্যগুলি বাদে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত তাঁর সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।
  • তক্ষশীলার বিদ্রোহ: তাঁর রাজত্বকালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ তক্ষশীলায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিন্দুসার প্রথমে তাঁর পুত্র সুসীমকে এবং পরে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র অশোককে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠান। অশোক সাফল্যের সঙ্গে এই বিদ্রোহ দমন করে নিজের প্রশাসনিক ও সামরিক দক্ষতার প্রমাণ দেন।

​কূটনৈতিক সম্পর্ক

​বিন্দুসার বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর পিতার নীতিকেই তিনি এগিয়ে নিয়ে যান।
  • গ্রিক সম্পর্ক: তিনি সিরিয়ার গ্রিক শাসক অ্যান্টিওকাস প্রথম সোটারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সিরিয়া থেকে ডেইমাকোস নামের এক রাষ্ট্রদূত তাঁর রাজসভায় এসেছিলেন।
  • ব্যক্তিগত অনুরোধ: গ্রিক সূত্র থেকে জানা যায়, বিন্দুসার অ্যান্টিওকাসের কাছে তিনটি জিনিসের জন্য অনুরোধ করেছিলেন: মিষ্টি মদ, শুকনো ডুমুর এবং একজন গ্রিক দার্শনিক। অ্যান্টিওকাস প্রথম দুটি জিনিস পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু বলেছিলেন গ্রিক আইন অনুসারে দার্শনিক বিক্রি করা যায় না।
  • মিশরীয় সম্পর্ক: মিশরীয় শাসক টলেমি ফিলাডেলফাসও তাঁর রাজসভায় ডিওনিসিয়াস নামের এক দূত প্রেরণ করেছিলেন বলে জানা যায়।


সম্রাট অশোক (273 - 232  খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশোকের সিংহাসন আরোহণ নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুসারে, অশোক ক্ষমতার জন্য তাঁর 99 জন ভাইকে হত্যা করেছিলেন। এরপর প্রায় চার বছর গৃহযুদ্ধের পর খ্রিস্টপূর্ব 269 অব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্যাভিষেক করেন। যদিও এই তথ্যটি ঐতিহাসিকদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে সমর্থিত নয়, তবুও এটি তাঁর প্রাথমিক কঠোর প্রকৃতির ইঙ্গিত দেয়। মগধের সিংহাসনে বসার আগে তিনি তক্ষশীলা এবং উজ্জয়িনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্ব পালনে আরো দক্ষ করে তোলে।

​কলিঙ্গ যুদ্ধ

  • যুদ্ধ ও ভয়াবহতা: ​আনুমানিক, 261 খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের রাজত্বকালের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সিংহাসনে আরোহণের আট বছর পর অশোক কলিঙ্গ রাজ্যে আক্রমণ করেন। কলিঙ্গ ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য এবং কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ লোক নিহত হয় এবং দেড় লক্ষ লোক বাস্তুচ্যুত হয়। এই ভয়াবহ রক্তপাত এবং মানবিক দুর্ভোগ সম্রাট অশোককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
  • অনুশোচনা ও ধর্মান্তর: যুদ্ধের পর অশোকের মনে এক গভীর অনুশোচনা জন্ম নেয়। তিনি সামরিক বিজয় বা 'দিগ্বিজয়'-এর পথ ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তের দ্বারা তিনি ধর্মীয় জীবনে প্রবেশ করেন। এই ঘটনা তাঁর ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে।

​ধম্মের ধারণা ও প্রচার

ধম্ম: ​ধর্মান্তরের পর অশোক 'ধম্ম' প্রচার শুরু করেন। এই 'ধম্ম' কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবাদ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি নৈতিক ও সামাজিক আচরণবিধি। এর মূল নীতি গুলি ছিল:
  • ​অহিংসা: জীব হত্যা নিষিদ্ধকরণ।
  • সহিষ্ণুতা: বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের প্রতি সহনশীলতা।
  • গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা: পিতা-মাতা এবং শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
  • দান ও জনকল্যাণ: দরিদ্র ও শ্রমণদের দান এবং জনকল্যাণমূলক কাজ অর্থাৎ সড়ক নির্মাণ, কূপ খনন, বিশ্রামাগার স্থাপন ইত্যাদি।
  • সত্যবাদিতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ।
​ধম্ম মহাপাত্র: ধম্ম প্রচারের জন্য তিনি 'ধম্ম মহাপাত্র' নামে বিশেষ রাজকর্মচারী নিয়োগ করেন, যারা জনগণের মধ্যে নৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতেন।
​শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি: অশোক তাঁর ধম্মের বার্তা দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ছড়িয়ে দিতে সারা ভারতে অসংখ্য শিলালিপি, স্তম্ভলিপি ও গুহালিপি স্থাপন করেন। এই লিপিগুলি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা ছিল। এগুলিই অশোকের শাসনকাল সম্পর্কে জানার প্রধান উৎস।

​বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা

​অশোক বৌদ্ধ ধর্মের একজন মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
  • ​তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি: আনুমানিক, খ্রিস্টপূর্ব 250 অব্দে তিনি তাঁর রাজধানী পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির আয়োজন করেন। এই সংগীতিতে বৌদ্ধ ধর্মের বিভেদ দূর করা এবং মগধের বাইরে ধর্ম প্রচারের কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
  • ধর্মপ্রচার: তিনি তাঁর পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য শ্রীলঙ্কায় পাঠান। এছাড়া তিনি মিশর, গ্রিস এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও ধর্মপ্রচারকদের পাঠিয়েছিলেন।
  • ​স্থাপত্য: তিনি বহু স্তূপ (যেমন বিখ্যাত সাঁচির স্তূপ) এবং বিহার নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত সারনাথের সিংহ স্তম্ভ মৌর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি বর্তমানে ভারতের জাতীয় প্রতীক
​অশোকের শাসনকাল প্রাচীন ভারতকে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে নয়, নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবেও পৃথিবীর দরবারে এক নতুন পরিচিতি এনে দিয়েছিল।

শেষ মৌর্য সম্রাট

সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর প্রায় পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী ধরে মৌর্য সাম্রাজ্য টিকে ছিল। এই সময়কাল ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি এবং দুর্বলতার যুগ। অশোকের বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর উত্তরসূরিদের দুর্বলতার কারণে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। পতনশীল মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ। আনুমানিক, খ্রিস্টপূর্ব 185 অব্দে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন তাঁরই ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। বৃহদ্রথকে হত্যার পর পুষ্যমিত্র শুঙ্গ পাটলিপুত্রের সিংহাসন দখল করে এবং শুঙ্গ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে মৌর্য সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। এবং প্রাচীন ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়।

মৌর্য যুগের সাহিত্য

মৌর্য যুগে রচিত সাহিত্য এবং এই সময়ের সাহিত্যিক উৎসগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিচে দেওয়া হলো। এই সাহিত্যগুলি থেকে আমরা মৌর্য যুগের প্রশাসন, সমাজ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারি।

​অর্থশাস্ত্র:

  • রচয়িতা: সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী তথা গুরু কৌটিল্য বা চাণক্য 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থটি রচনা করেন।
  • বিষয়বস্তু: এটি রাষ্ট্রনীতি, প্রশাসন, সামরিক কৌশল, কূটনীতি, আইন, এবং অর্থনীতির উপর রচিত একটি বিশদ গ্রন্থ। এটিকে প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়।
  • গুরুত্ব: এটি থেকে মৌর্যদের কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রশাসন, কর ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা এবং সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সরাসরি বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। এটিতে একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্রের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল, যা মৌর্য প্রশাসনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

​ইন্ডিকা:

  • রচয়িতা: 'ইন্ডিকা' গ্রন্থটি রচনা করেন মেগাস্থিনিস। তিনি ছিলেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় আগত, গ্রিক সম্রাট সেলিউকোস নিকেটরের দূত
  • বিষয়বস্তু: ইন্ডিকা মূল পাণ্ডুলিপিটি এখন আর পাওয়া যায় না। তবে পরবর্তী গ্রিক ঐতিহাসিক যেমন আরিয়ান, স্ট্রাবো, প্লিনি এবং জাস্টিনের লেখায় এর কিছু অংশ উদ্ধৃত হয়েছে।
  • গুরুত্ব: এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে মৌর্যদের রাজধানী পাটলিপুত্র শহরের বর্ণনা, চন্দ্রগুপ্তের প্রশাসন, ভারতীয় সমাজের সাতটি শ্রেণী (দার্শনিক, কৃষক, পশুপালক, শিল্পী, সৈন্য, পরিদর্শক ও কাউন্সিলর), দাস প্রথার অনুপস্থিতি এবং সামরিক প্রশাসনের তথ্য জানা যায়।

দীপবংশ ও মহাবংশ:

এই শ্রীলঙ্কান পালি গ্রন্থ দুটি থেকে মূলত সম্রাট অশোকের ধর্মান্তরের ঘটনার বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া, এগুলি থেকে তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রার শ্রীলঙ্কা যাত্রা এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। এগুলিতে অশোকের প্রাথমিক জীবন ও সিংহাসন আরোহণ নিয়েও কিছু বিবরণ রয়েছে।

​দিব্যাবদান ও অশোকাবদান:

সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই গ্রন্থগুলিতে অশোকের জীবন, তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ, তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজ এবং বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণের বিষয়ে কিংবদন্তী কাহিনী রয়েছে।

​পরিশিষ্টপর্বণ:

'পরিশিষ্টপর্বণ' গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন জৈন গ্রন্থকার হেমচন্দ্র। এই গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জীবনের শেষ ভাগে জৈন ধর্ম গ্রহণ এবং জৈন গুরু ভদ্রবাহুর সাথে দক্ষিণ ভারতে গমনের বিশদ বিবরণ রয়েছে।

​মুদ্রারাক্ষস:

বিশাখদত্ত রচিত এই নাটকটি গুপ্তযুগে লেখা হলেও এর পটভূমি হলো মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এটিতে চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তের সহায়তায় কিভাবে নন্দ বংশের পতন হয়েছিল, তার কাহিনি বর্ণনা রয়েছে।

মৌর্য স্থাপত্য ও শিল্পকলা

মৌর্য স্থাপত্যে কাঠ ও ইটের ব্যবহার থেকে শুরু করে পাথর খোদাই শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ​মৌর্য স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির বেশিরভাগই মূলত সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে।

অশোক স্তম্ভ

  • বিশেষত্ব: এগুলি মনোলিথিক মাধ্যমে অর্থাৎ একক পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে এগুলি ছিল মসৃণ এবং অত্যন্ত পালিশ করা। এগুলির উদ্দেশ্য ছিল অশোকের ধম্মের বার্তা প্রচার করা।
  • সারনাথ স্তম্ভ: সবচেয়ে বিখ্যাত স্তম্ভটি হলো সারনাথের সিংহ স্তম্ভ। এর স্তম্ভশীর্ষে রয়েছে চারটি সিংহ মূর্তি, যা বর্তমানে ভারতের জাতীয় প্রতীক।


স্তূপ:

  • উদ্দেশ্য: বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেহাবশেষ বা গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ নিদর্শন সংরক্ষণ করার জন্য অর্ধ-গোলাকৃতির স্তূপ গুলি তৈরি করা হতো।
  • সাঁচি স্তূপ: অশোক কর্তৃক নির্মিত সবচেয়ে বিখ্যাত স্তূপ হলো মধ্যপ্রদেশের সাঁচির মহা স্তূপ। এটি মৌর্য স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।


গুহা স্থাপত্য:

  • বারাবার গুহা: বিহারের বারাবার এবং নাগার্জুনী পাহাড়ে অবস্থিত গুহাগুলি মৌর্য যুগের স্থাপত্যের অন্যতম উদাহরণ। এগুলি সাধারণত সন্ন্যাসী ও আজীবক সম্প্রদায়ের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এগুলির ভেতরের অংশ আয়নার মতো পালিশ করা হয়েছিল।


মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ 

  • দুর্বল উত্তরাধিকারী: অশোকের পরবর্তী রাজারা এত বড় সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করার মতো যোগ্য ছিলেন না। তাঁদের দুর্বলতার সুযোগে প্রদেশগুলি নিজস্ব স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করে।
  • কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি: মৌর্য প্রশাসন ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত, যেখানে রাজার ক্ষমতাই ছিল সর্বেসর্বা। পরবর্তীতে অশোকের মতো শক্তিশালী শাসক না থাকায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যায়।
  • অশোকের অহিংস নীতি: কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, অশোকের চরম অহিংস নীতি এবং সামরিক বাহিনীতে কম মনোযোগের ফলে মৌর্য সেনাবাহিনীর শক্তি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। ফলে বাহ্যিক আক্রমণ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • বিশাল সাম্রাজ্যের ব্যয়ভার: বিশাল সেনাবাহিনী এবং বিস্তৃত প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যয় বহন করা দুর্বল রাজাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এর ফলে রাজকোষে টান পড়ে।
  • প্রাদেশিক বিদ্রোহ: তক্ষশীলা এবং অন্যান্য দূরবর্তী প্রদেশে বারবার বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।
  • অর্থনৈতিক চাপ ও কর বৃদ্ধি: বিশাল সাম্রাজ্যের খরচ মেটাতে সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post