স্থিতির ধারণা
• সংজ্ঞা: যদি কোনো বস্তু সময়ের সাথে সাথে তার পারিপার্শ্বিকের বা নির্দেশক তন্ত্রের সাপেক্ষে তার অবস্থান পরিবর্তন না করে, তবে বলা হয় বস্তুটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।
• স্থিতির মূল শর্ত: স্থিতি বোঝাতে হলে সর্বদা দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে:
- সময় পরিবর্তন: অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হতে হবে।
- আপেক্ষিক অবস্থান: এই অতিবাহিত সময়ে বস্তুটির পারিপার্শ্বিক বস্তুর সাপেক্ষে তার দূরত্ব বা দিক অপরিবর্তিত থাকতে হবে।
• উদাহরণ: স্থিতির সবথেকে ভালো উদাহরণ হল একটি বন্ধ ঘরে টেবিলের উপর রাখা একটি বই। ঘরের দেওয়াল, মেঝের মতো পারিপার্শ্বিক বস্তুর সাপেক্ষে বইটি যতক্ষণ স্থির আছে, ততক্ষণ সেটি স্থিতিতে রয়েছে।
![]() |
| টেবিলের ওপর রাখা বই (স্থিতিশীল বস্তু) |
• স্থিতির আপেক্ষিকতা: স্থিতি কোনো চরম ধারণা নয়, বরং এটি সর্বদা আপেক্ষিক। এই বিষয়টি স্থিতির ধারণা বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- নির্দেশক তন্ত্রের ভূমিকা: কোনো বস্তুকে স্থিতিশীল বলার জন্য আমাদের একটি নির্দেশক তন্ত্র নির্ধারণ করতে হয়, যার সাপেক্ষে পরিমাপ করা হবে।
- পর্যবেক্ষকের ভিন্নতা: ধরুন, আপনি একটি চলন্ত ট্রেনের ভেতরে বসে আছেন। আপনার পাশে বসা সহযাত্রীর সাপেক্ষে আপনি স্থিতিশীল। কিন্তু, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বাইরের পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে আপনি ট্রেনের গতিতে গতিশীল।
- সিদ্ধান্ত: যেহেতু ট্রেনের ভেতরে আপনি স্থিতিশীল এবং বাইরে থেকে দেখা পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে আপনি গতিশীল, তাই বলা যায়, স্থিতিশীলতা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের সাপেক্ষে সংজ্ঞায়িত হয়।
• মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ: পৃথিবী এবং তার উপরের সবকিছুই, যেমন আপনার হাতে থাকা মোবাইল বা ঘরের আসবাবপত্র, ঘরের সাপেক্ষে স্থির হলেও, তারা সবাই পৃথিবীর সাথে সূর্যের চারিদিকে দ্রুত গতিতে ঘুরছে। তাই মহাবিশ্বের চরম স্থিতি বলে কিছু নেই।
গতির ধারণা
• সংজ্ঞা: যদি কোনো বস্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার পারিপার্শ্বিকের বা নির্দেশক তন্ত্রের সাপেক্ষে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে, তখন বস্তুটিকে গতিশীল অবস্থায় আছে বলা হয়।
• গতির মূল শর্ত: গতি বোঝাতে হলে সর্বদা দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে:
- সময় পরিবর্তন: গতি পরিমাপের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কালের প্রয়োজন।
- অবস্থান পরিবর্তন: পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে বস্তুটির প্রাথমিক এবং অন্তিম অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য থাকতে হবে।
• উদাহরণ: গতির সবথেকে ভালো উদাহরণ হল একটি চলমান ট্রেন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো একজন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে ট্রেনটি প্রতি মুহূর্তে তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। আবার, আর একটি উদাহরণ হল একটি পুকুরে সাঁতার কাটা মাছ। মাছটি জলের সাপেক্ষে তার অবস্থান পরিবর্তন করছে।
![]() |
| চলন্ত ট্রেন (গতিশীল বস্তু) |
• গতির আপেক্ষিকতা: স্থিতির মতোই, গতিও একটি আপেক্ষিক ধারণা। কোনো বস্তুকে গতিশীল বলার জন্য একটি স্থির নির্দেশক তন্ত্রের প্রয়োজন।
- নির্দেশক তন্ত্র: যে কাঠামোর সাপেক্ষে আমরা গতি পরিমাপ করতে পারি সেটিই হল নির্দেশক তন্ত্র।
- আপেক্ষিকতা: একই বস্তু ভিন্ন নির্দেশক তন্ত্রের সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে থাকতে পারে বা স্থিরও থাকতে পারে। যেমন, একটি বাসে বসা যাত্রী। বাসের সাপেক্ষে তিনি স্থির, কিন্তু রাস্তার পাশের গাছের সাপেক্ষে তিনি বাসের বেগে গতিশীল।
- মূল কথা: পরম গতি বলে কিছু নেই। একজন পর্যবেক্ষক যে নির্দেশক তন্ত্রে আছেন, তার সাপেক্ষে অন্য বস্তুর গতিকেই আমরা 'গতি' বলি।
গতির প্রকারভেদ
গতি সাধারণত দুই প্রকার:
1. চলন গতি:
• সংজ্ঞা: যখন কোন বস্তু সরলরেখা বরাবর চলতে থাকে, তখন তার গতিকে চলন গতি বলে।
• বৈশিষ্ট্য:
- চলন গতির ক্ষেত্রে বস্তুর বিভিন্ন কণার সরণ একই হয়।
- বস্তুর সব কণার রৈখিক বেগ এবং রৈখিক ত্বরণ একই সময়ে সমান হয়।
- বস্তুর সাপেক্ষে কোনো অক্ষের চারিদিকে বস্তুটি ঘোরে না।
• উদাহরণ: কোন বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে সেটি সরলরেখা বরাবর নিচে পড়তে থাকবে। নিচের দিকে পড়তে থাকা ওই বস্তুটির গতিকে তখন বলা হবে চলন গতি।
2. ঘূর্ণন গতি:
• সংজ্ঞা: যখন কোনো গতিশীল বস্তু একটি নির্দিষ্ট অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে থাকে, তখন সেই বস্তুর গতিকে ঘূর্ণন গতি বলা হয়।
• বৈশিষ্ট্য:
- এটি হলো সেই কাল্পনিক রেখা, যা বস্তুর কেন্দ্রে বা বাইরে থাকতে পারে, যার চারিদিকে বস্তুটি ঘোরে। অক্ষের উপর অবস্থিত কণাগুলি স্থির থাকে এবং তাদের রৈখিক গতি শূন্য হয়।
- ঘূর্ণন অক্ষ থেকে দূরত্ব অনুসারে কণাগুলির অতিক্রান্ত পথ ভিন্ন হয়। অক্ষ থেকে যত দূরে কণাটি থাকবে, তার দ্বারা অতিক্রান্ত বৃত্তের পরিধি এবং রৈখিক বেগ তত বেশি হবে।
- ঘূর্ণনশীল বস্তুর সব কণার কৌণিক বেগ এবং কৌণিক ত্বরণ একই হয়। কৌণিক বেগ হলো একক সময়ে অতিক্রান্ত কৌণিক সরণ।
• উদাহরণ: ঘূর্ণন গতির সবথেকে ভালো উদাহরণ হল ঘূর্ণায়মান বৈদ্যুতিক পাখা গতি। এবং লাটিমের ঘূর্ণন।
গতি সংক্রান্ত কয়েকটি রাশি
1. দূরত্ব
• সংজ্ঞা: কোনো গতিশীল বস্তু যে পথ ধরে চলে, সেই পথের মোট দৈর্ঘ্যকে দূরত্ব বলে।
• বৈশিষ্ট্য:
- এটি একটি স্কেলার রাশি। এর শুধু মান আছে, কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই।
- দূরত্ব সর্বদা ধনাত্মক হয়। গতিশীল বস্তুর দূরত্ব কখনও শূন্য বা ঋণাত্মক হতে পারে না।
- এস.আই (SI) পদ্ধতিতে দূরত্বের একক হলো মিটার (m)।
• উদাহরণ: যদি কোনো ব্যক্তি সোজা পূর্ব দিকে 2 km হেঁটে আবার পশ্চিম দিকে 3 km হাঁটেন, তাহলে তার অতিক্রান্ত মোট দূরত্ব হবে 2 km + 3 km = 5 km।
2. সরণ
• সংজ্ঞা: কোনো গতিশীল বস্তুর প্রাথমিক অবস্থান থেকে অন্তিম অবস্থানের মধ্যেকার সর্বনিম্ন সরলরৈখিক দূরত্বকে সরণ বলে।
• বৈশিষ্ট্য:
- এটি একটি ভেক্টর রাশি। এর মান ও দিক উভয়ই আছে।
- সরণ ধনাত্মক, ঋণাত্মক বা শূন্যও হতে পারে। যদি কোনো বস্তু বৃত্তাকার পথে চলতে চলতে আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে, তবে সরণ শূন্য হবে।
- এস.আই (SI) পদ্ধতিতে সরণের একক হলো মিটার (m)।
• উদাহরণ: যদি কোনো ব্যক্তি 5 km পূর্ব দিকে গিয়ে 3 km পশ্চিম দিকে ফিরে আসেন তাহলে, প্রাথমিক অবস্থান থেকে ওই ব্যক্তি এখন 5 km - 3 km = 2 km পূর্ব দিকে আছেন। এই 2 km পূর্ব দিকেই হলো ওই ব্যক্তির সরণ।
3. দ্রুতি
• সংজ্ঞা: একক সময়ে কোনো বস্তু যে দূরত্ব অতিক্রম করে, তাকে দ্রুতি বলে। দ্রুতি হলো গতিশীলতার একটি পরিমাপ।
• বৈশিষ্ট্য:
- এটি একটি স্কেলার রাশি। দ্রুতির মান আছে কিন্তু অভিমুখ নেই।
- দ্রুতি সর্বদা ধনাত্মক হয়।
- এস.আই (SI) দ্রুতির একক হলো মিটার প্রতি সেকেন্ড (m/s)।
• প্রকারভেদ:
- সমদ্রুতি: যদি কোনো বস্তু সমান সময়ের ব্যবধানে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে, তবে বস্তুটির দ্রুতিকে সমদ্রুতি বলা হয়।
- অসমদ্রুতি: যদি কোনো বস্তু সমান সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্ব অতিক্রম করে, তবে বস্তুটির দ্রুতিকে অসমদ্রুতি বলা হয়।
- গড় দ্রুতি: মোট অতিক্রান্ত দূরত্বকে মোট সময় দিয়ে ভাগ করলে যা পাওয়া যায়, তাকে গড় দ্রুতি বলে।
4. বেগ
• সংজ্ঞা: একক সময়ে কোনো নির্দিষ্ট দিকে বস্তুর সরণের হারকে বেগ বলে। এটি হলো বস্তুর গতির দিকসহ একটি পরিমাপ।
• বৈশিষ্ট্য:
- এটি একটি ভেক্টর রাশি। বেগ বলতে সর্বদা মান এবং দিক বোঝায়।
- বেগের মান ধনাত্মক, ঋণাত্মক বা শূন্য হতে পারে।
- বেগের এস.আই (SI) একক হলো মিটার প্রতি সেকেন্ড (m/s)।
5. ত্বরণ
• সংজ্ঞা: সময়ের সাথে বস্তুর বেগের পরিবর্তনের হারকে ত্বরণ বলে। অর্থাৎ, কোনো বস্তুর বেগ কত দ্রুত বাড়ছে বা কমছে, তা ত্বরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
• বৈশিষ্ট্য:
- এটি একটি ভেক্টর রাশি। ত্বরণের দিক, বেগের পরিবর্তনের দিকের সাথে একই হয়।
- ত্বরণের এস.আই (SI) একক হলো মিটার প্রতি সেকেন্ড স্কোয়ার (m/s2)।
• ত্বরণের প্রকারভেদ:
- ধনাত্মক ত্বরণ: যদি সময়ের সাথে সাথে বস্তুর বেগ বাড়ে, তাহলে সেই ত্বরণকে ধনাত্বক ত্বরণ বলে।
- ঋণাত্মক ত্বরণ বা মন্দন: যদি সময় বাড়ার সাথে সাথে বস্তুর বেগ কমে, তাহলে সেই ত্বরণকে ঋণাত্বক ত্বরণ বলে। যেমন: ব্রেক কষার সাথে সাথে গাড়ির গতি কমতে থাকা।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি
1. প্রশ্ন: "সব স্থিতিই আপেক্ষিক, কোনো স্থিতিই পরম নয়"- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: আমাদের মহাবিশ্বে স্থিতি বা গতির কোনো পরম অস্তিত্ব নেই। মহাবিশ্বের সব বস্তুই গতিশীল। কোনো বস্তুকে স্থিতিশীল বলতে হলে একটি নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষক বা নির্দেশক তন্ত্রের প্রয়োজন হয়। যেমন, ঘরে থাকা একটি চেয়ার আমাদের সাপেক্ষে স্থির হলেও, মহাকাশ থেকে দেখলে দেখা যাবে সেটি পৃথিবীর সাথে ঘুরছে। যেহেতু মহাবিশ্বে এমন কোনো বস্তু নেই যা স্থির, তাই পরম স্থিতি বলে কিছু হয় না।
2. প্রশ্ন: সমদ্রুতিতে চললেও কোনো বস্তুর বেগ কি পরিবর্তিত হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, হতে পারে। বৃত্তীয় গতির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে থাকে। যখন কোনো বস্তু বৃত্তাকার পথে সমদ্রুতিতে ঘোরে, তখন প্রতি মুহূর্তে তার গতির দিক পরিবর্তন হয়। যেহেতু বেগের একটি নির্দিষ্ট দিক থাকে, তাই দিক পরিবর্তনের কারণে বস্তুর বেগও পরিবর্তিত হয়।
3. প্রশ্ন: কোন বস্তুর গড় দ্রুতি শূন্য নয় কিন্তু গড় বেগ শূন্য হতে পারে কী?
উত্তর: হ্যাঁ, কোনো বস্তুর গড় দ্রুতি শূন্য না হলেও গড় বেগ শূন্য হতে পারে। যখন কোনো বস্তু যে বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে আবার সেই বিন্দুতেই ফিরে আসে, তখন তার মোট সরণ শূন্য হয়; ফলে মোট সরণকে সময় দিয়ে ভাগ করলে গড় বেগও শূন্য হয়। কিন্তু বস্তুটির অতিক্রান্ত মোট দূরত্ব কখনোই শূন্য হয় না বলে মোট দূরত্বকে সময় দিয়ে ভাগ করলে গড় দ্রুতির একটি নির্দিষ্ট মান পাওয়া যায়। অর্থাৎ বলা যায়, বস্তুর গড় দ্রুতি শূন্য নয় কিন্তু গড় বেগ শূন্য হতে পারে।

